লাইলী ইয়াসমীন
গুলতেকিনের বিয়েকে আমি দেখছি একজন নারীর সাহস হিসেবে। অবশ্য তার এই সাহসের পেছনের কারিগর তার সন্তানরা। যাদের তিনি সেভাবেই তৈরি করতে পেরেছেন। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সন্তানরা মায়ের বিয়ে, মায়ের প্রেম, মায়ের বন্ধুত্ব প্রভু সমাজপতির কড়া নজরে দেখে। মায়ের সংগ্রাম খুব কম সন্তানের কাছে গুরুত্ব পায়।
একা মায়ের পরিবার বা বাবার পরিবারে কেউ আর বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা বা আলাদা থাকা কোনো নারীর দায় নিয়ে চায় না। এমন মায়েদের আবারও নতুন জীবনে প্রবেশের সুযোগ দিলে তার সন্তানদের দেখাশুনা পরিবারগুলোতে বর্তাবে বলেই তারা সব সময় এটাকে নিরুৎসাহিত করে। এটা এক ধরণের সম্পর্কের সাথে সহমরণের মতো। তোমার সাথে সেই মানুষটি (যার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছিল) নাই মানে তুমি জীবনহীন এক শরীর মাত্র। এই শরীরের কোন দাবি থাকতে পারবে না, শরীরের ভেতরে কোন মনের বসবাস চলবে না যা তোমার নিজেকে ভাবাবে।
মা বিধবা হলে, মায়ের তালাক হলে বা নিয়তিদৃষ্টে মায়ের সেপারেশন হলে সন্তানরা মাকে একজন পাথর হৃদয়ের, লৌহ শরীরের মানুষের মহিমা দিয়ে ছেড়ে দেয়। যতক্ষণ মায়ের দায়িত্বশীলতা বা সেবা সন্তানের দরকার পড়ে ততক্ষণই তারা মায়ের সন্তান। একসময় ঠিকই তারা নিজের নিজের সুবিধা বা লাভজনক জায়গায় চলে যায়, যখন একবারও তারা মায়ের কথা ভাবে না। মায়ের একাকিত্বকেই সন্তানরা মায়ের নিয়তির দায় বলে ছেড়ে দেয়। যেমন সন্তানকে পাশে রেখে, আগলে রেখে, মমতায় রেখে বড় করার দায় সমাজ একা মায়ের উপর একছত্র ছেড়ে দেয়।
অথচ যেকোন বয়সের একজন পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে, স্ত্রী অসুস্থ হলে, কোন কারনে তালাক হলে যত দ্রুত সম্ভব সেই পুরুষের বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। সন্তানরাও সেক্ষেত্রে কয়েক পা এগিয়ে থাকে। বিয়ে না হলে এই পুরুষ নিঃসঙ্গ এটা যেমন সমাজ বোঝে, তেমন সন্তানরাও। একা পুরুষ প্রেম করবে, বন্ধুত্ব করবে এটা খুব স্বাভাবিক সবার কাছে। শুধু কি একা! একজন পুরুষ স্ত্রী পরিবার রেখেও যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় কোন সম্পর্কে গড়ায় তখনও বড় জোর তাদের একটু মৃদু শাসন করা হয়। পুরুষের গোপন বিয়ে থাকে, গোপন প্রেম থাকে। কখনই সন্তান তাদের জন্য তেমন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না।
গুলতেকিনকে রেখে যখন হুমায়ুন আহমেদ মেয়ের বয়সী শাওনের প্রেমে পড়ে যান, তখন একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা ছিল ঘরের মানুষ ঘরে ফেরার। ফেরেননি। প্রেম এমনি। পুরুষের প্রেম আরো বেশি অন্ধ। বয়সের তোয়াক্কা তাদের কম। তালাক হওয়ার পর হুমায়ুন বিয়ে করলেন। আর গুলতেকিন বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটলেন একা। শরীরহীন এক আত্মার মতো। যাই হোক এবার তিনি বিয়ে করলেন।
বিয়ের সাথে শুধুমাত্র যৌনতার সম্পর্ক নেই এই ধারণাটাই আমাদের সমাজে অজানা। দুইজন নারী-পুরুষ ভালো বন্ধু হতে পারে, একসাথে থাকতে পারে, একজনের পাশে বসে অন্যজনের হাত ধরতে পারে, হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে পারে, কপালে হাত রেখে উষ্ণতা মাপতে পারে এমনটা কয়জন মানে! এই সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ে নামক একটা দালিলিক চুক্তি ছাড়া নারীতে-পুরুষে এমন সম্পর্ক মানেই অবৈধ। মোটকথা নিঃসঙ্গতাকেই ধর্ম বলে জ্ঞান করা হয়। যদি কেউ তার বাইরে যেতে পারে তারাও নিঃসঙ্গ হয় সামাজিক অপরাধে।
গুলতেকিন ৫৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছেন এটা এমন কোন মাইল ফলক নয়। তিনি যা করেছেন তা ন্যায্যতা। একটা সাহস। এরপর হয়তো অনেকে সাহসী হবেন, তবে যদি গুলতেকিনের মতো সন্তান তার পাশে থাকে, আর থাকেন আফতাব আহমেদের মতো একজন প্রেমিক।
সম্পাদক
জলেশ্বরীডটকম