বিভাজনে পথের দিশা হারিয়েছে বাংলাদেশ

মাসকাওয়াথ আহসান

আজকের এই রাজনৈতিক বিভেদের তিক্ত পরিসরটিকে ধর্মীয় বিভেদের মতোই তিক্ত এক পরিসর হিসেবে যখন দেখি; তখন এই বিভেদের স্বরূপ সন্ধানের প্রয়োজন বোধ করি। কারণ বাংলাদেশের সমান বয়েসী হওয়াতে বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মিত হয়েছে আমার চোখেরই সামনে। এক্ষেত্রে কোন কথিত ইতিহাসবিদের লেখা ইতিহাস গ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধান করতে হচ্ছে না; এ খুবই স্বস্তির বিষয়।

আমার বেড়ে ওঠা প্রাচীন রেল-শহর ঈশ্বরদী আর শিক্ষা-নগরী রাজশাহীতে। মুসলিম-লীগ, আওয়ামী লীগ, ভাসানি ন্যাপ, জাসদ, বিএনপি-র লোকেদের যৌথ পরিবারের বিভিন্ন ঘরে ‘দলগুলো’-কে পিতা-পুত্র, ভাইয়ে-ভাইয়ে রাজনৈতিক আদর্শের বিভাজন হিসেবেই প্রত্যক্ষ করেছি। ঈশ্বরদীতে আত্মীয়ের বাড়িতেই এক ঘরে আওয়ামী লীগের নেতা, আরেক ঘরে জাসদের নেতা, ঠিক পাশের ঘরেই বিএনপির নেতা দেখে বিস্মিত হয়েছি। ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা তরুণদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিলে দেখেছি।

কাজেই নব্য ফেসবুক শিক্ষিত কিংবা হোয়াটস এপ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রদের যখন খাঁটি লীগের রক্ত খুঁজতে দেখি; তখন কৌতুক জাগে। রাজনীতিকে নিজেদের যাপিত জীবনে না খুঁজে; দলীয় ন্যারেটিভ নির্মাণে ব্রতী কথিত ইতিহাসবিদদের পক্ষপাতদুষ্ট বয়ান থেকে খুঁজতে দেখে আরো তীব্র কৌতুক বোধ করি। সে কারণে সিরিয়াস লেখালেখির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে রম্যগল্পেই খুঁজি যাপিত জীবনের নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা।

রাজশাহী শহরে একজন আত্মীয়ের বাড়িতেই মুসলীম লীগের তাবড় নেতার পুত্রকে পিতার রাজনৈতিক আদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা হতে দেখেছি। আবার আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে ভাসানি ন্যাপের নেতাকে বিএনপির জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। তার বাড়িতে তারই আরেক ভাইকে দেখেছি আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে। এই যে চোখে দেখা রাজনৈতিক বিভাজনের রসায়ন; সেটিকে উড়িয়ে দিয়ে ‘দলীয়’ ইতিহাসবিদকে যখন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তির বিভাজন রেখা এঁকে দিয়ে ধর্মীয় হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মতোই তিক্ত আরেকটি মারণঘাতী বিভাজনের বিষ ছড়াতে দেখি; খুবই অবাক লাগে। বাস্তবে দেখা সত্য–একই পরিবারে রাজনৈতিক আদর্শের যে বৈচিত্র্য দেখেছি; তাতে ঢাকায় লিভিং রুমে বসে ইতিহাস চর্চার রাজরোগাহত দলীয় ইতিহাসের ন্যারেটিভ নির্মাতাদের কৌতুক-উদ্দীপক বলে মনে না হয়ে উপায় নেই।

যে পরিবারগুলোর কেসস্টাডি সামনে রেখেছি; এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। কাজেই ইদানিং ক’টা ইতিহাস গ্রন্থ কনসাল্ট করে একটি দলের খুঁটিতে জীবন বেঁধে কিছুলোককে দিনমান বিভাজন সংগীত গাইতে দেখে এটুকু বোঝা যায়, এরা ‘আমরা বনাম ওরা’-র হাডুডু খেলে ক্ষমতা দখল, জমি দখল, চাকরি দখল করার প্রত্যয়ে দৌড়ে বেড়ানো ঘাতক সমাজ। কারণ জীবনকে বিকশিত করে ভালোভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সামর্থবান কোন মানুষ; রক্তের হোলি খেলে-অন্যকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে; অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও সেকেন্ড হোমের সংস্থান করতে চাওয়ার কথা নয়।

আমার বন্ধুদের মাঝে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাসদ-বামদের বিন্যাস ও বৈচিত্র্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এরকম সর্বদলীয় আড্ডাগুলোকে রাজনৈতিক আদর্শিক বিভাজনের কচকচানিতে কখনো তিক্ত হতে দেখিনি। এসব কচকচানি আর খাঁটি রক্ত খুঁজে বেড়ানোর বাতিক প্রথম চোখে পড়েছে ফেসবুকে।

বিতর্ক-চর্চা আর বিতর্ক আন্দোলন ছিলো আমার বিকল্প রাজনীতি চর্চার প্লাটফর্ম। সেসব বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছাড়াই স্ব-উদ্যোগে চলে আসতো আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাসদ-বামদলগুলোর ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতারা। তাদের আগ্রহ আর প্রশংসা অনুপ্রাণিত করতো। তারা সবাই ‘বিতর্ক’ আন্দোলনের পক্ষে ছিলো। তারা মনে করতো এরকম নৈর্ব্যক্তিক রাজনীতি-চর্চার পরিসর খুবই জরুরি।

এই যে পারস্পরিক সহাবস্থানের-সহমর্মিতা-পরমত সহিষ্ণুতার পরিবেশ হারিয়ে গেলো; এটা হলো তরুণদের জীবন বিকাশে দলীয় সাহায্যের প্রয়োজন এসে পড়ায়। অন্ন-বস্ত্র-বাড়ি-গাড়ি-বিলাসিতা-সেকেন্ডহোমের চাহিদাপূরণে দলীয় সহযোগিতা নিয়ে যারা বেড়ে ওঠে; তারা চর দখলের খুনে ফুটসোলজার হিসেবে; পিঠে রক্তজবার মতো বর্শা গেঁথে যাওয়ার বেদনা নিয়ে প্রতিপক্ষের পিঠে শাবল চালিয়ে দিতে মারমুখী।

এই নরভোজি ‘গেম অফ থ্রোনস’ থেকে সমাজকে বের করে নিয়ে না আসতে পারলে; বাংলাদেশ কখনোই পথের দিশা পাবে না। যে আওয়ামী লীগ-হেফাজত বনাম বিএনপি-জামায়াত কাবাডির মারণ-খেলায় বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়েছে; সেখানে নিজের ব্যর্থ হবার দায় প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে লুন্ঠনের মহাযজ্ঞে নব্য জমিদার বা নিও-এলিট হবার যে উদগ্র বাসনা; সদ্য দারিদ্র্য সীমার নীচ থেকে লাফ দিয়ে দলীয় পদ্মফুল খাওয়ার ‘লোটাস ইটার’ হওয়া নব্য ধনীদের রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ-সমাজ বাঁচাতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কোন ‘বিশুদ্ধ রক্ত’ নেই। আফ্রিকা-চীন-ইরান-মধ্য এশিয়া থেকে ব্যাপক অভিবাসন ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক আগে। কথিত ‘সান অফ দ্য সয়েল’ বলে যে কিছু নেই তা সাম্প্রতিক নানা গবেষণায় ডিএন এ-র নির্ভুল পরীক্ষায় খুবই স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং খাঁটি রক্ত যারা খুঁজছে এরা সেই জার্মানির খুনে নাতসিদের মতো নরভোজের ক্ষুধায় উন্মত্ত; এই প্রবণতা খুবই ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশে; সভ্যতার ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় সেই অশনি সংকেত খুব স্পষ্ট।
লেখক ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *