আমি সাংবাদিক, তাই চুল ভেজাবো না

শান্তা মারিয়া

গ্রামের মেয়েরা এখনও শ্বশুর ও ভাসুরের সামনে যেতে হলে মাথায় কাপড় দেয়। তাই সাংবাদিকতা পেশায় থাকা নারীকেও মাথায় কাপড় দিতে হবে। সম্পাদক যদি হন শ্বশুরসম মাননীয় তাহলে নিউজ এডিটর অবশ্যই বড় ভাসুর। আর চিফ রিপোর্টার হলেন মেজ ভাসুর, ফিচার এডিটর ছোট ভাসুর। এদের সকলের সামনেই মাথায় কাপড় দিয়ে যাওয়া দরকার। তাহলে ছেলেরা কি করবে? ধরুন সম্পাদক নারী, নিউজ এডিটরও নারী, চিফ রিপোর্টারও তাই, ছেলে সাংবাদিকরা কি তখন শাশুড়িসম মাননীয়াদের সামনে যেতে গেলে মাথায় টুপি পরবে?

ভেজা চুলে বাইরে যাওয়া নাকি যৌন ইংগিতময়! ভেজা চুলে নারী সাংবাদিক ঘোরাঘুরি করলে তার উপরে ধর্ষক লাফিয়ে পড়তে পারে। তাই চুল ভেজানো চলবে না। আর চুল যদি ভিজেই যায় তাহলে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এজন্য প্রতিটি মিডিয়া হাউজে হেয়ার ড্রায়ার থাকা বাধ্যতামূলক। অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার সময় এবং হাউজের ভিতরেও( কারণ হাউজের ভিতরে কোন পুরুষের মনে কি আছে কে জানে? ভেজা চুল দেখে যদি কারও উত্তেজনা বেড়ে যায় তখন করণীয় কী?) চুল ভালো করে শুকিয়ে রাখতে হবে।

বুলেট প্রুফ জ্যাকেটও চাই। কুড়িগ্রামের দোকানে দোকানে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বিক্রি হচ্ছে তো, তারই একটা করে প্রত্যেককে সংগ্রহ করার উপদেশ বিলিয়েছেন নাকি কোন তালেবর।

ও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। আংটি চাই। কার আংটি? কিসের আংটি? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সেই মনমাতানো উপন্যাস ‘হীরের আংটি’র কথা বলা হচ্ছে? না সত্যজিত রায়ের ‘বাদশাহী আংটি’? সেই যে যেখানে ফেলুদা তার গোয়েন্দাগিরির খেল দেখিয়েছিলেন? আরে না, সেসব নয়। এ হলো বিয়ের আংটি। বলেন কি? নিরাপত্তার জন্য আঙুলে সবসময় বিয়ের আংটি পরে থাকতে হবে? শুনেছিলাম জ্যোতিষীরা নানা রকম পাথর আংটিতে পরে ধারণ করতে বলেন। গোমেদ, রক্তপ্রবাল, চুণী, পান্না, হীরা কতকি। রক্তমুখী নীলা নাকি আবার সকলের সহ্য হয় না। এটাও কি সেই ব্যাপার নাকি? নিরাপত্তার জন্য আংটি ধারণ। না সেসব নয়।

আংটি ধারণ করতে হবে কারণ তাহলে বোঝা যাবে আপনি বিবাহিত। আর বিবাহিত বলে জানলে আপনি যৌন হয়রানি থেকে মুক্ত বিহংগসম থাকতে পারবেন। কেন এদেশে কি পাঁচ সন্তানের জননী বিবাহিতরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে না? প্রতিদিন পত্রিকায় দেখছি গৃহবধূ ধর্ষণ, তাহলে? ধর্ষক কি আগে কাবিননামা দেখে তারপরে অগ্রসর হয়? যারা যৌন হয়রানি করে তারা আগে কাবিননামা পরীক্ষা করে? কেন ওটা কি সার্চ ওয়ারেন্ট? এরা বিবাহিত অবিবাহিত বাছে নাকি?এসব প্রশ্নই মনে জাগছিল সম্প্রতি।

কুড়িগ্রামে এক কর্মশালায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ: নারী সাংবাদিকের নিরাপত্তা’ পোশাক সংক্রান্ত প্রস্ততি বিষয়ে এসব অতি মূল্যবান উপদেশ ঝাড়েন। প্রথমত সাবজেক্টটা দেখেই তো আমার আক্কেল গুড়ুম। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আর নারী সাংবাদিকের নিরাপত্তায় পোশাকের প্রসঙ্গ উঠছে কেন? এতো সেই বস্তাপচা, দুর্গন্ধযুক্ত পুরুষতান্ত্রিক গোবর যেখানে বলা হয় ‘দ্যাখ মাইয়া, তোর কাপড় চোপড়ের দোষেই তোরে ওই ব্যাডারা তোরে হয়রানি করছে। হ্যাগো কুনো দোষ নাই, দোষ তুর কাপড়ের। তুই হেইরকম পোশাক পিনছস ক্যা?’

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নারীর ড্রেসকোড নির্ধারণ করার চিন্তাটাই তো বমি উদ্রেককারী। আর সেই কথা বলছেন কিনা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রোকেয়া বেঁচে থাকলে এই শিক্ষককে তুলোর মতো ধুনতেন। তারওপর এই শিক্ষক বলছেন এসব মসালা নাকি তার উর্বর মস্তিষ্কের নিজস্ব উত্পাদন নয়, তিনি খালি ব্যাখ্যাকারী। তিনি বিদেশি গাইড লাইন দেখে ভাসুর-শ্বশুরের প্রসঙ্গ এনে বিষয়টির দেশীয়করণ করেছেন মাত্র।

এগুলো নাকি তিনি ধার করেছেন ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সেফটি ইনস্টিটিউট, রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস, ইউনেসকো, নিউজ নেটওয়ার্কের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন এমন সাংবাদিকদের ব্যবহারের জন্য প্রণীত সুরক্ষা ম্যানুয়ালসহ বিভিন্ন গাইডলাইন দেখে। (মানে যেমনটি তিনি এর আগে তার পিএইচডি থিসিস করার সময় কপিপেস্ট জাতীয় কাজকারবার করেছিলেন বলে অনুমেয়)। যাহোক, তাহলে তো দেখা যাচ্ছে মাথা একা এই লোকের খারাপ হয়নি। বিলাতি সর্ষের মধ্যেও তাহলে যথেষ্ট পরিমাণে ভূত আছে।

কথা হলো এই বিলাতি পুরুষতান্ত্রিক ফরমুলাবাজদের জিজ্ঞাসা করি ‘আরব বসন্ত’র নিউজ করার সময় কায়রো শহরের বুকের উপর যে নারী সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি যদি বিয়ের আংটি পরে থাকতেন বা তার চুল যদি ভেজা না থাকতো(নিশ্চয়ই তার চুল একেবারে জবজবে ভেজা ছিল) তাহলে তিনি ওই শতখানেক নরপশুকে প্রতিরোধ করতে পারতেন?

সমাজ ও রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে পুরুষতান্ত্রিক ভূত না ঝাড়া অবধি সাংবাদিকতা কেন কোথাও কি নারীর রেহাই আছে যৌন হয়রানির হাত থেকে? নারীর পোশাক, বিয়ের আংটি, শুকনা চুল এগুলো কি এতই শক্তিশালী যে নরপশুদের প্রতিহত করতে সক্ষম? এগুলো কি সুপারম্যানের বিখ্যাত লাল আন্ডার ওয়্যার?

সোজা কথা হলো যৌন হয়রানির প্রতি জিরো টলারেন্স, কঠোর আইন শৃংখলা ব্যবস্থা আর নারী-বান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাই পারে এ হয়রানি বন্ধ করতে। তাই নারীর নিরাপত্তা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক কর্মশালাগুলো নারীদের নিয়ে নয়, করা হোক পুরুষদের মানুষ করে তোলার জন্য।

# লেখক, সাংবাদিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *