জলেশ্বরী

নারী সাংবাদিকের জন্য আরোপিত পুরুষতান্ত্রিক সুরক্ষা ম্যানুয়াল

লাইলী ইয়াসমীন

নারীর চুলে নাকি সেক্স অনুভব করে পুরুষ, তাই নারীকে পর্দা করতে মানে চুল ঢেকে রাখতে হয়। এটুকুই শুনে এসেছি সারাকাল। কিন্তু নারীর ভেজা চুলে যে যৌনতার ইঙ্গিত থাকে, সেটা আজ প্রথম শুনলাম। মানে নারী ভেজা চুলে পুরুষকে আহবান জানাবে যৌনতায়। সেটা আবার নারী সাংবাদিকের ভেজা চুল। তাই নারী সাংবাদিককে নিজের নিরাপত্তার জন্য ভেজা চুলে কাজে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। নারী সাংবাদিকদের হাতে বিয়ের চিহ্ন স্বরূপ আংটি পরতে বলা হয়েছে। যাতে বিবাহিত বুঝতে পারলে কেউ যৌন হয়রানী না করে। তার মানে কি বিবাহিত নারীরা যৌন হয়রানী বা সহিংসতার শিকার হয় না? সাংবাদিকদের নিয়ে এক ওয়ার্কশপের আলোচনার কিছু কিছু বিষয় ও তাদের ম্যানুয়াল পড়ে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।

কর্মশালায় উপস্থাপিত একটি স্লাইড।

আরো বলা হয় নারী সাংবাদিকদের পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হতে হবে। লম্বা ও ঢিলেঢালা শেপলেস পোষাক পরা, মাথায় স্কার্ফ পরা, পুরু বেল্ট পরা নারী সাংবাদিকের জন্য নিরাপদ। ছোট বা আটোসাঁটো পোশাক, নেকলেস পরা, পুরুষের সাথে করমর্দন করা বা উচ্চস্বরে হাসা, ধুমপান-মদ্যপান উচ্ছৃঙ্খলতার উদাহরন বলে বিবেচিত হবে।

কোন বিক্ষোভ সমাবেশের রিপোর্ট করতে গেলে নারী সাংবাদিককে কয়েক স্তরের পোশাকের নিচে স্থানের পোশাক পরে শক্ত বেল্ট দিয়ে আটকিয়ে নিতে হবে। সাথে একজন বিশ্বস্ত পুরুষ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যিনি আপনাকে দেখে রাখবে, সুরক্ষা দেবে।

নারী সাংবাদিকতা করবে, আর পুরুষ গার্ড তাকে নিরাপত্তা দেবে। এটা কিভাবে সম্ভব? এই বিশ্বস্ত পুরুষ খোঁজার বিজ্ঞাপন আগেই দিতে হবে, যদি নারী সাংবাদিকতা করতে চান।

যদি আক্রান্ত হয়েই যান তবে বলুন আপনি ঋতুবতি, অসুস্থ, আপনার এইচ আই ভি আছে। তারপরেও যদি রক্ষা না পান আপনি বমি করুন। তবে হয়তো আপনি রেহাই পাইতে পারেন।

আলোচনা হচ্ছিল নারী সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিয়ে। আলোচক তার স্লাইট প্রেজেন্টেশন দেখিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। কোথাও কোথাও প্রশ্ন করলে তার ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। তবে মাঝে মাঝেই তিনি বলছেন, ‘অধিকাংশ নারীই মনে করে তারা ঘরের বাইরে কাজ করার যোগ্য না। অধিকাংশ নারীই মনে করে তারা ঝুঁকি নিতে পারবে না। অধিকাংশ নারী মনে করে তারা নিজেকে সাজগোছ করিয়ে সুন্দর দেখাতে পারলেই হলো। তাই তারা নিজের সময় ব্যয় করে সাজগোজে। পুরুষ তো চায়ই নারীকে সুন্দর দেখাক। নারীরাও তাই চায়।’

আলোচনাস্থলে আমি একমাত্র নারী হওয়ায় প্রতিবাদ ধোপে টিকবে না জেনেও মাঝে মাঝে আপত্তি তুলছিলাম। কিন্তু প্রেজেন্টার তার স্থানে অনড়। নারীর সুরক্ষা দিতে নারীকে বন্দি করে রাখা যে পুরুষতান্ত্রিকতা, সেই ধারণাই যে স্পষ্ট এই আলোচনায়।

# সাংবাদিক, লেখক।

Exit mobile version