নারীবাদ বোঝা ও পড়া (পর্ব ৩)

শারমিন শামস্।।

নারীবাদ আন্দোলন ঠিক যখন থেকে তার ডানা মেলেছে, ঠিক তখন থেকেই নারীবাদিদের গালিগালাজ করবার প্রচলনটাও শুরু হয়েছে। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার! পিতৃতন্ত্র ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর দাসত্বের অন্যায় রীতি খুইয়ে ফেলার আতংকে বরাবর হিংস্র আক্রমন করেছে নারীবাদ আন্দোলন আর নারীবাদিদের।

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের বইটি (A vindication of the rights of woman) প্রকাশিত হল আঠারো শতকে। সম্ভবত মেরিই সেই নারীবাদি, যিনি প্রথম প্রকাশ্যে অনেক বাধভাঙা কথা বললেন, যতখানি আগে কেউ বলেননি। বলতে পারি, বলার সাহস করেননি। কিন্তু মেরি বললেন। মেরি লিখলেন প্রথাগত বিবাহ রীতির বিরুদ্ধে। মেরি বিয়েকে বললেন ‘পতিতাবৃত্তি’। সমাজের মাথায় যেন বাজ পড়ল একটা। সেই আঠারো শতকে, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, মেরির কথা চরম আঘাত হয়ে নেমে এল পুরুষতন্ত্রের মুখে।

মেরি লিখলেন, নারীকে পড়ালেখা ও অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে পুরুষের চেয়ে দুর্বল করে রাখা হয়েছে, যাতে সে পুরুষের খেলনা হয়ে উঠতে পারে। তাকে পুরুষের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়। মেরি প্রশ্ন তুললেন, কেন নারীর জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের চেয়ে বিয়েকেই বেশি প্রধান্য দেয়া হয়? পুরুষের ছায়াতলে যে বিবাহিত জীবন, সেই জীবনকে মেরি স্রেফ পতিতার জীবন বলে স্পষ্ট লিখে দিলেন।

না, এত সাহস মেরির আগে আর কেউ দেখাননি। মেরিকে চিহ্নিত করা হল, ‘Radical’ বলে। সমাজ বলল, তিনি উগ্র, অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। একটি সংবাদপত্র মেরির কঠোর সমালোচনা করল, যা ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেল। তারা তাকে অভিহিত করল, ‘Hyena in petticoats’ বলে। মানে পেটিকোট পরা হায়েনা। এই সমালোচনা শুধু তার বইয়ের জন্য না, সমালোচনা হল তার জীবনযাপন ধরণের জন্যও। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট তো প্রথাগত ছিলেন না, তিনি সমাজের হাজার বছরের বেধে দেয়া রীতিতে জীবন কাটাননি। সমাজ তাকে আঘাত করতে এটাকেই ছুঁতো হিসেবে তুলে নিল। যুগে যুগে এভাবেই ডাইনী বধ প্রথা চলে এসেছে। যে নারী অন্যায় রীতিকে চ্যালেঞ্জ করে, তাকেই ডাইনী বলে বধ করে ফেলা- অতি চেনা কায়দা। মেরির কপাল ভাল ছিল বলা যায়। তাকে পুড়িয়ে মারেনি অন্তত। হায়েনা বলে ডেকে আর হাজারটা নোংরা সমালোচনা করে ছেড়ে দিয়েছে।

এ যেন ঠিক এই বাঙালি সমাজ। পার্থক্যটা হল, এটি ইউরোপে আঠারো শতকের কথা। সেই ইউরোপ এখন এগিয়ে গেছে। কিন্তু এই ২০১৯ এর বাংলাদেশ আজো সেই মধ্যযুগীয় সমাজচেতনাই বহন করে চলছে।

The Blue Stockings Society

প্রথম তরঙ্গের নারীবাদের কথা বলতে গেলে ব্লু স্টকিংস সোসাইটির কথা আসবেই। ইংল্যান্ডের শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকজন নারীর উদ্যোগে ১৭৫০’র দিকে ব্লু স্টকিংস সোসাইটি গড়ে ওঠে। এর পেছনে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন Elizabeth Montagu, Elizabeth Vesey এবং আরো কয়েকজন। এর নারী সদস্যরা শিক্ষিত সচেতন সাহিত্যবোদ্ধা পুরুষদের এই সোসাইটিতে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তারাও সদস্য হতে পারতেন। নারী ও পুরুষ একসাথে বসে আলোচনা করতেন সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে। সেই ১৮ শতকের গোড়ার দিকে এই ধরণের উদ্যোগ বেশ বৈপ্লবিক ছিল। কারণ ব্লু স্টকিংসের উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষা বিস্তার ও সচেতনতা বাড়াতে নারী ও পুরুষের মধ্যে সহযোগিতামূলক বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। তখন যেকোন আড্ডায় জুয়া আর মদ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ব্লু স্টকিংস সোসাইটির সদস্যরা জুয়া আর মদকে দূরে রেখে সাহিত্য আলোচনা করতেন এবং চা আর লেমনেড পান করতেন।

ব্লু স্টকিংস অনেক নারীকে সাহিত্যিক হবার পথ তৈরি করে দিয়েছে। এদের মধ্যে আছেন Fanny Burney, Hannaf More, Sarah Scott, Anna Laetitia Barbauld প্রমুখ। সেই সময়ে এই নারী লেখকরাই সমাজের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নারীরা তাদের আপন শক্তিতে সাহিত্য রচনার যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছিলেন। তাদের লেখায় নারীবাদের চিন্তা চেতনা ছিল সুস্পষ্ট। পুরুষের পাশে নারীর সক্ষমতাকে তারা বারবার তুলে ধরেছেন, দাবি জানিয়েছেন সমতার।

সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লেখক, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্য সমালোচক Elizabeth Montagu কে বলা হত Queen of the blues। সে সময় সাহিত্যজগতে তার যথেষ্ট প্রভাব তৈরি হয়েছিল। চরম পুরুষতান্ত্রিক সেই সমাজেও ব্লু স্টকিংস নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিল।

নারীবাদ আন্দোলনের শুরু থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অর্থাৎ লেখালেখি, তর্ক বিতর্ক আলোচনা ইত্যাদির পাশাপাশি মাঠের সংগ্রামও চলছিল। নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় এই দুটিরই গুরুত্ব সমান। লেখালেখি একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। একই সাথে সে সময় ভোটের জন্য আন্দোলন, নারী শ্রমিকের অধিকারের লড়াই- সবই চলেছে।

আঠারো শতকের নারীবাদ আন্দোলন অবশ্যম্ভাবীভাবেই কঠিন ছিল। তবু এই সময় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জ্ঞান বিজ্ঞান ও যুক্তির চর্চা শুরু হয়, কুসংস্কার ও অন্ধ রীতিনীতির প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ হতে শুরু করে। নারী ও পুরুষের সমতা এবং নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় একই মাত্রায়। আবার চিন্তা চেতনার কারণে বুদ্ধিজীবীদের ভেতরেও বিভাজন তৈরি হয়। অনেক প্রতিভাধর লেখকও নারী পুরুষের সমতার ধারণাটা মেনে নিতে পারেনি। দার্শনিক রুশো (Jean Jacques Rousseau) তাদেরই একজন।

আঠারো শতকে দার্শনিক হিসেবে রুশো গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাকে ধরা হত Enlightenment philosopher হিসেবে। রুশো মানুষে মানুষে সমতার কথা বলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হল, তার এই ‘মানুষ’ এর মধ্যে তিনি নারীকে গন্যও করেননি। নারীকে তিনি সমতার ধারণা থেকে স্পষ্টত সম্পূর্ণ বাদ রেখেছিলেন। সমতা নিয়ে রুশোর তত্ত্ব সমাদৃত, অথচ বাস্তবতা হল, রুশো মনে করতেন এই সমতা শুধু পুরুষের প্রাপ্য, নারী এর যোগ্যই নয়। তার কারণ হিসেবে তিনি প্রচার করেছিলেন, প্রাকৃতিকভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে অধম আর দুর্বল। তাই তাদের পুরুষের অধীন থাকাটাকেই ঠিক মনে করতেন তিনি। রুশোর মত হল, নারীকে তার ভালোর জন্যই পুরুষের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ নারীর কোন যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞান নেই।

চরম পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার দার্শনিক রুশো নারীকে ছাড়াই পুরুষ দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে বলে মত দেন। প্রকৃত অর্থে নারীর অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করে গেছেন রুশো। রুশোর চোখে নারী এতটাই নিচু স্তরের যে তাদের শিক্ষা দীক্ষা পাবার কোন দরকার আছে বলে তিনি মনে করতেন না। কারণ নারীর জন্মই হয়েছে স্ত্রী ও মা হয়ে সকলের খেদমত করার জন্য।

রুশো লিখেছেন, “Once it is demonstrated that man and woman are not, and should not be constituted the same, either in character or in temperament, it follows that they should not have the same education. In following the directions of nature they must act together but they should not do the same things; their duties have a common end, but the duties themselves are different and consequently also the tastes that direct them. After having tried to form the natural man, let us also see, in order not to leave our work incomplete, how the woman is to be formed who suits this man.”

তো এই ছিল সে সময়ের বিখ্যাত ও সমাদৃত দার্শনিকের নারীর প্রতি চিন্তাভাবনার প্রকাশ ও প্রচারের ধরণ।

এখন রুশো শারীরিকভাবে পুরুষ বলেই কি এমন পুরুষতান্ত্রিক গোঁয়ার ছিলেন?

না, এমনটা ভাবা পুরোপুরি যৌক্তিক হবে না। কারণ বহু পুরুষ দার্শনিক লেখক সে সময় নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন। এদের মধ্যে Denis Diderot, Marquis de Condorcet, Jeremy Bentham এর কথা বলতেই হয়। এরা প্রত্যেকেই সে সময় প্রকাশ্যে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার কথা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন এবং তারা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস রাখতেন। তার মানে সেই ১৮ শতকেও নারীবাদি মানে শুধু নারীই ছিলেন না, বহু পুরুষও নারীবাদি ছিলেন এবং এর জন্য লড়েছেন। এই সূত্রে অবধারিতভাবে চলে আসে John Stuart Mill এর নাম, নারীবাদ আন্দোলনে যার অবদান চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হবে।

John Stuart Mill

আঠারো শতকের ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ভ্যানিটি ফেয়ার (দ্বিতীয়) ১৮৭৩ সালে তাদের একটি সংখ্যায় বিখ্যাত শিল্পী Spy (ছদ্মনাম, আসল নাম Sir Leslie Matthew Ward ) এর করা জন স্টুয়ার্ড মিলের একটা ক্যারিকেচার ছাপিয়েছিল। ক্যারিকেচারে দেখা যায় মিল তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবির ক্যাপশন হল- “A Feminine Philosopher”।

John Stuart Mill (১৮০৬-১৮৭৩) ছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তা।

মিল লিবারাল পার্টির সদস্য ছিলেন, হয়েছিলেন আইনসভার সদস্য। আজীবন কথা বলেছেন বাকস্বাধীনতার পক্ষে। লড়েছেন নারী অধিকার ও নারী পুরুষের সমতার জন্য। ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এর সদস্য Henry Hunt এর পরই মিল নারীদের ভোটাধিকারের পক্ষে প্রস্তাব রাখেন।

১৮৬১ সালে মিল লেখেন The subjection of women। প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ এ। বইটার চিন্তা দীর্ঘদিন ধরে মিল তার স্ত্রী Harriet Taylor Mill (১৮০৭-১৮৫৮) এর সাথে শেয়ার করেছিলেন।

ব্রিটিশ মেয়ে হেরিয়েট প্রথম স্বামী John Taylor কে ছেড়ে এসেছিলেন। জন স্টুয়ার্ড মিলের সাথে জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন হেরিয়েট। কারণটা ছিল- স্টুয়ার্ড মিল তাকে নারী নয়, একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখতেন, শ্রদ্ধা করতেন। হেরিয়েটের বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করতেন মিল। এদিকে সে সময়ের সমাজ নারীর এই ছেড়ে আসাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। নানান কুৎসা রটেছে হেরিয়েটের বিরেুদ্ধে। খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন হেরিয়েট। পরে প্রথম স্বামী টেইলরের মৃত্যুর পর তিনি মিলকে বিয়ে করেন।

হেরিয়েট নারী নির্যাতন নিয়ে লিখতেন। তবে খুব কমই নিজের নামে তা প্রকাশ করতেন। মিল সবসময় স্বীকার করে এসেছেন তার লেখা ও চিন্তায় হেরিয়েটের প্রভাবের কথা।

The subjection of women এ মিল লিখে গেছেন বিয়ে কীভাবে নারীকে দমন করে রাখে। মিল এই রীতি বদলে ফেলা জরুরি বলে মত দিয়েছেন। তিনি নারী পুরুষের সমতার কথা লিখে গেছেন। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে সামাজিক ও লৈঙ্গিক কাঠামো, শিক্ষা এবং বিবাহ প্রথা নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা বলেছেন। শিক্ষা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নারীকে সম্পৃক্ত করার কথা বলেছেন। পুরুষ নারীর চেয়ে বুদ্ধিতে বেশি, কারণ তার মগজ নারীর চেয়ে বড়- এই চরম অবৈজ্ঞানিক ধারণাটিকে সেই আঠারো শতকেই চরম ভুল উল্লেখ করে উড়িয়ে দিয়েছেন মিল।

The subjection of women এ মিল স্পর্শ করতে পেরেছেন নারীর জীবনের সেইসব স্থান, যা আগে কেউ ভেবেও দেখেনি, খেয়ালও করেনি। মিল লিখেছেন,

“Independently of the regular domestic and social duties that are laid on a woman, she is expected to have her time and abilities always at the disposal of everybody. Even if a man doesn’t have a profession to exempt him from such demands, no-one is offended if he devotes his time to some pursuit that he has chosen; ‘I am busy’ is accepted as a valid excuse for not responding to every casual demand that may be made on him. Are a woman’s occupations, especially the ones she chooses, ever regarded as excusing her from any of the demands of society? Even her most necessary and recognised duties are barely allowed as exempting her.” [The subjection of women, পৃষ্ঠা-৪৪]

(চলবে…)
লেখক, সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *