মাসকাওয়াথ আহসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শফি ভাইয়ের সঙ্গে দিনে কয়েকবার দেখা হতো। অপরাজেয় বাংলার পাশে, মধুর ক্যান্টিনে, টিএসসিতে, কলাভবনে। আমাদের বন্ধুবৃত্তের নায়ক আহকাম, পরাগ জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার কারণে আমাদের মধ্যে জাসদ ছাত্রলীগের প্রতি অনুরাগ ঘন হতে দেখে শফিভাই একদিন ডেকে গম্ভীরভাবে বললেন, মন দিয়ে পড়ালেখা করো। তুমি লেখালেখি করবে ভবিষ্যতে কেমন।
আমি বেশ আশাহত হয়েছিলাম। এরপর একদিন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে টিএসসিতে আহকাম ও পরাগ মিছিল জমায়েত করছিলো; প্রেসক্লাবের দিকে যাবে বলে। পরাগ আমাকে মিছিলে যেতে মানা করে নিজের শার্ট তুলে পুলিশের বাড়ির দাগ দেখিয়ে বললো, তুই সহ্য করতে পারবি না। তুই এইখানেই থাক।
আহকাম বুঝিয়ে বললো, পুলিশ এসে পড়লে আমরা যে যেদিকে পারি পালাই। তুই গেলে আমরা ঝামেলায় পড়ে যাবো।
শফি ভাই চোখের ভাষায় আমাকে টিএসসিতেই থাকতে বললেন। শফি ভাই এমন একজন ছাত্রনেতা ছিলেন, যিনি অনুজপ্রতিমদের প্রত্যেকের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতেন। সাধারণত বড় ছাত্রনেতারা যেভাবে কর্মীদের এক্সপ্লয়েট করেন; উনি সেসব হিপোক্রেসি একদম পছন্দ করতেন না।
উনার সঙ্গে দেখা হলে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। বিশ্বসাহিত্যে ঝোঁক ছিলো তার। অবসর বিনোদন বলতে ছিলো গ্রন্থপাঠ। টিভি ডিবেটে চ্যাম্পিয়ান হওয়ায় একদিন আমাকে ডেকে ট্রিট দিয়েছিলেন।
অমর একুশে বইমেলায় আমাদের “স্পন্দনে”-র স্টলে মাঝে মাঝে আসতেন; গল্প করতেন জাহানারা ইমামের সঙ্গে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন সূত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয় শফি ভাইয়ের।
একদিন আহকাম বললো, ওরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগে যোগ দেবার কথা। মনে হলো বেশ তো; নব্বুইয়ের গণ অভ্যুত্থানের নায়কেরা জাতীয় নেতৃত্বের দিকে এগোনোই তো দেশের জন্য ভালো। ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন তো সেখানেই। এমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপের গণতন্ত্রে যেমনটা হয়।
অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেয়া সেকালের ছাত্রনেতাদের জাতীয় নেতৃত্বে অল্পস্বল্প অংশগ্রহণ থাকলেও পুরোনো ধাঁচের রাজনীতির ইলেক্টেবলদের প্রাধান্যই ছিলো সেখানে। নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের নায়কদের নিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো; কিছু ব্যতিক্রম বাদে। এই দেশটি যেন, “এক ঘারমে দো পীর যাও বাছা শো রাঁহো” বলে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নেতৃত্বের লাশ কাটা ঘর।
প্রবাদ প্রতিম ছাত্রনেতা শফি আহমেদ; ক্যারিশমেটিক নেতার সব বৈশিষ্ট্য যার মাঝে; যিনি বিএনপি-জামাতের আমলে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে গেলেন; এক এগারোর কালে সেই নব্বুই-এর গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য জীবন পণ করলেন। ঢাকার রাজনীতির পাশাপাশি নিজের এলাকায় যার জনপ্রিয়তা কিংবদন্তীর মতো; তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন একবার সেটা এক এগারোর আগে। এক এগারোর পর বসন্তের কোকিলেরা সব তার এলাকায় মনোনয়ন পেতে শুরু করলো। জনপ্রতিনিধিত্ব যেন “আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া।”
গত পনেরো বছর ধরে শফি আহমেদকে রাজনৈতিকভাবে তিলে তিলে হত্যাদৃশ্যটি চোখের সামনে দেখলাম।
শফি ভাইয়ের পারিবারিক সুনাম, ঐতিহ্য, সেই সাদা রাজহাঁসের মতো দোতলা বাড়ি; যেখানে শফি আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে নৌকায় করে ভেসে আসতো হাওরের মানুষ। সবাই আপ্যায়িত হতো ভালোবাসায়; ফিরে যেতো ভালোলাগার অশ্রু নিয়ে। জন্মগতভাবে মাসলোর হায়ারার্কি অর্জন করা যে মানুষটি সামাজিক সাম্যের স্বপ্ন দেখতেন, কল্যাণ রাষ্ট্রের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুবাদ দেখতে চেয়েছিলেন; তার অকাল মৃত্যু এই দুর্নীতি আর নৈরাজ্যের জব্বারের বলি খেলা বেনজির সমাজে অবশ্যম্ভাবী ছিলো।
যে গণতন্ত্রের জন্য নিজের তারুণ্য ও যৌবন উতসর্গ করেছিলেন শফি ভাই; সেই গণতন্ত্রের মৃত্যু হলে, তার তো মৃত্যু হবেই। শফি আহমেদ নামটিই যে গণতন্ত্রের প্রতিশব্দ।
শফিভাই জাসদ হয়ে আওয়ামী লীগে এলেও; বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উদ্ভাস ছিলো তার ব্যক্তিত্বে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে যেমন দেশের ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার উচ্চারণ চোখে পড়ে; সোশ্যাল মিডিয়ায় শফি ভাইয়ের লেখাগুলোতে তার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। যেদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়; সেখানে শফি আহমেদের নেতৃত্বকে হত্যা করা হবে এটা চিরন্তন সত্য।
এক এগারোর আগে রাজনীতির সঙ্গে যাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না; আওয়ামী লীগের সুখের তরীতে সওদা করা সেরকম দু’একজন সওদাগরকে দেখেছি শফি ভাইয়ের ফেসবুক স্টেটাসের মন্তব্য ঘরে এসে রাজনীতি শেখাচ্ছেন এই বলে, ভুল পলিসির সমালোচনা দলের রুদ্ধ দ্বার কক্ষে করা ভালো। ব্যাক-ডোর পলিসিতে সংসদের জুয়ার আসর আর মন্ত্রীসভার নবরত্নসভায় জায়গা করা এইসব লোকের স্পর্ধা দেখে; সত্যজিত রায়ের “জলসাঘর” চলচ্চিত্রের নতুন বড়লোক চরিত্রটির কথা মনে পড়েছিলো। বড্ড কৌতুককর এসব ফিলিস্টাইন্স।
বাংলাদেশ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যাঁরা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকেন; তারা ক্ষমতার কালো জাদুকর হননা কখনো। এইখানে হেরে যাওয়াই জিতে যাওয়া; আর জিতে যাওয়াই হেরে যাওয়া।
শফি আহমেদ ২০১৪-১৮-২৪-এর গণতন্ত্র হত্যাপ্রকল্পের নির্বাচনে নিজ এলাকায় পূর্ণ জনসমর্থন নিয়ে জিতে এলেও; তাকে ইতিহাসে গণতন্ত্র হত্যার দায় নিতে হতো। নব্বুই এর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে মহাছাত্রনায়কের নামটি নক্ষত্র হয়েছিলো; প্রকৃতি সে নক্ষত্রের পতন দেখতে চায়নি বলেই; বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাসে শফি আহমেদ অমর হয়ে রয়ে গেলেন।
তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে স্পেনের কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার হত্যা দৃশ্যের ছবি প্রায়ই শেয়ার করতেন ফেসবুকে। এ যেন শফি ভাইয়েরই হত্যাদৃশ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ সরজমিন পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে; ভারতের আম আদমী দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পাকিস্তানের পিটি আই নেতা ইমরান খানের মতো তৃতীয় একটি রাজনৈতিক দল গড়ার সক্ষমতা ছিলো শফি ভাইয়ের।
কিন্তু মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দুটি রাজনীতির মাজার কেন্দ্রিক যে লালসালু রাজনৈতিক সংস্কৃতি; যেরকম আত্মবিনাশী ধর্মান্ধ আর দলান্ধের উর্বর ভূমি এই বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপের চোরের খনির চাটার দল; সেখানে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সমর্থিত আওয়ামী মৌলবাদ বনাম কট্টর ইসলামপন্থা সমর্থিত বিএনপি মৌলবাদ; মোদিচিন্তার কাঁচামাল উপনিবেশ বনাম ইয়াহিয়াচিন্তার ছাই প্রচ্ছায়া; আঠারো কোটি মানুষের নেমেসিস ; সেখানে বাংলাদেশ চেতনার অজর মানুষ শফি আহমেদ যেন আগন্তুকের মতো; নিজভূমে পরবাসী।
শফি আহমেদের জীবনের অপচয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে, সৎ ও মেধাবী ছেলেরা ছাত্র রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, অভিমানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া বাংলাদেশ বুদ্ধিমত্তা, সোনালি যুগের জ্ঞান নির্ভর সমাজ নিজেকে গুটিয়ে নেয়া,শুক্তির বুকে মুক্তোর মতো স্বপ্ন ঘুমিয়ে থাকার কারণগুলো ।
অথচ শফি আহমেদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আলোক সম্ভবা মৃত্যুঞ্জয়ী স্কোয়াড হয়ে ওঠার কথা অনাগত তারুণ্যের। নরভোজি ক্ষমতা উপনিবেশ থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার দায়িত্ব তো তারুণ্যের। পূর্ব-পুরুষের আত্মত্যাগ, কৃষক-শ্রমিকের রক্তে-ঘামে দাঁড়িয়ে থাকা অমিত সম্ভাবনাময় একটি দেশ; এখানে আর কত ফুলের বুকে ঘুমিয়ে থাকা ফুলের মধু খেয়ে!
অশ্রু নয়; সততা, নিষ্ঠা, ঘুরে দাঁড়ানো, সত্যান্বেষণ, সত্য উচ্চারণের সাহস শফি আহমদের মতো মানুষের রেখে যাওয়া সম্পদ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই লিডার শফি আহমদের শেষ যাত্রায় দেশপ্রেমিক প্রজন্মের পুষ্পস্তবক। দেখা হবে শফি ভাই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।