জলেশ্বরী

এক রাত্রির গান

এক

সে এক অভূতপূর্ব রাত
হাতের মুঠোয় ছিল সে-ও শুধু হাত
হাতে হাতটাই নেই থেকে গেছে রাত
রাতটা কি মাঝরাতে শেষ হয়ে যাবে অকস্মাৎ?

এক শুধু রাতটুকু হাতে
তোমার সম্মুখে আমি সূর্যের সাক্ষাতে।
আমাকে কি নেবে তুমি নেবে এই ফেরা
নাই যদি নেবে তুমি নেবে কি আমাকে নক্ষত্রেরা?

নিত্য রাতে কালের করাতে
জীবনটা যাচ্ছেতাই চেরে ফাঁড়ে হাতে।
এই এক দিব্য অন্তহীন মধ্যরাত
কেউ কি কোথাও করে অভাগার জন্য অশ্রুপাত?

দুই

সে রাতের কথা কী যে বলি
চোখের চেয়ে কি কালো কলঙ্ককজ্জলি?
কী কথা জানাই আমি কাকে আজ লিখে
কী আছে নেবার মূল্যবান সেই রাত থেকে শিখে?

সে রাতটা যায় আর আসে
রাতটা থাকেই ধারে কাছে আশে পাশে
কাঁদায় হাসায় ভালোবাসায় এখনো
সে রাতের কথা তবে তোমাকেই কিছু বলি শোনো।

নিচের তলায় ছোট্টো ঘর
রাত নেমেছিল অর্ধশতাব্দীর পর।
ছিল বুঝি রাত চোখে ছিল কন্ঠস্বরে
কী যে কথা হয়েছিল সেই রাতে সারারাত ধরে!

সেই এক অপার্থিব রাতে
স্বপ্ন ছিল এক হাতে সত্যি অন্য হাতে।
দুজন একাই ছিল স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা
ছিল সুপ্ত সমুদ্রেরা আর ছিল তীর্থ নক্ষত্রেরা।

ছিল আলো ছিল অন্ধকার
ছোট্টো ঘর তবুও ছিল না কোনো পার।
ঘর খুব ছোটো থেকে বড়ো হতে হতে
ভেসে গিয়েছিল দূর দূরান্তের সমুদ্রের স্রোতে।

সেই এক অনিঃশেষ রাতে
একটিই মাত্র রাত দুজনের হাতে
ওরা ছিল একটি রাতের অন্তরীণ
ছিলনাকো পূর্বরাত্রি ছিলনাকো পরবর্তী দিন।

ওরা ভেঙে গড়ে এক রাতে
গড়ে হাতে রাত রেখে গড়ে খালি হাতে।
যতই পড়িনে কেন পাতা ফুরোবে না
কত কী যে লেখা হলো মেঘনা যমুনা ভল্গা লেনা!

কী করে যে সেই ছবি আঁকি
কী করে রেখায় রঙে ক্ষতচিহ্ন ঢাকি?
কী করে বা গাই অমৃততৃষ্ণার গান
কবি নই শব্দপুঞ্জ কী করে বা পাবে আর প্রাণ?

উদ্ধার করো না যদি পারো
যত লিখি ততো বেশি দুঃখ পাবে আরো।
এ লেখার ছিল শুরু নেই বুঝি শেষ
কাল শুধু ভেঙে যায় সেই সাথে ভেঙে যায় দেশ।

ভেঙে যায় অক্ষরে অক্ষরে
সেই রাত আসবে কি আর কোনো ঘরে?
ভেঙে যায় সুর ছন্দ গান গল্পগাঁথা
দীর্ঘশ্বাসে জ্বলে পুড়ে ঝরে যায় বৃক্ষদের পাতা।

যখনই শব্দেরা আসে হাতে
চোখের নিমেষে চলে যায় সেই রাতে।
তিলেক দণ্ডটি কেউ থাকে না এখানে
চতুর্দিক ছোটে সাড়া দিতে সেই রাত্রিরই যে গানে।

প্রত্ন সেই রাত্রি তীর্থসম
ছিল না কি তবে ইতিহাসে দীর্ঘতম?
হ্রস্বতম ছিলনাকি একরাত্রি সেই
আজ আর একটিও পূর্বরাত্রি কারো হাতে নেই।

তিন

তারারা তো এসেছিল নেমে
যাত্রাস্তব্ধ সময় কি গিয়েছিল থেমে?
আদিগন্ত খোলা ছোট্টো জানালার পাশে
ঘুমিয়ে কি পড়েছিল ওরা বহিরাঙ্গনের ঘাসে?

দীর্ঘতম মানিনে কী করে
অদ্যাবধি এক চুলও এসেছি কি সরে?
যেতে কি পেরেছি নিরুদ্দিষ্ট পর্যটনে
দূর বহুদূর দীপান্তর অন্য কোনো গৃহকোণে?

অপরূপ কাব্যশিল্পকলা
হোক যত রিক্তশস্য হোক সে নিস্ফলা
সেই রাতে একমাত্র এ-আমি বিস্ময়
ভূ-ভারতে কেউ যেন আর কোনো কিচ্ছুটিই নয়।

সে রাতের সমস্ত পৃথিবী
আজ পরিত্যাক্ত এক প্রত্নউইঢিবি।
না কোনো মন্দির দেখি না কোনো বিগ্রহ
ফেরা ছাড়া দেখিনেকো দিনান্তের আর কোনো দ্রোহ!

আমরা সুন্দর হবো সব
সুন্দর হবেই হবে আমাদের স্তব
দুঃখ থাকবে না আর কারো ব্যক্তিগত
দুঃখদরিদ্রতামুক্তি সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের ব্রত।

শস্যক্ষেত কারখানা কলে
শহর বন্দর গ্রাম কাদামাটিজলে
কোনো জনপদ কিংবা কোনো তীর্থস্থানে
যুদ্ধ জানেনাকো কেউ শুধু প্রেম আর মৈত্রী জানে।

সাড়ে তিন হাত মাটি নয়
চাই গোটা পৃথিবীই গুরু তলস্তোয়।
চাই সকলের জন্য প্রেমময় ঘর
চাই সকলের কথা বলা অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর।

চাই সকলের স্বাধীনতা
চাই স্বপ্ন গান আর কবিতার কথা
সত্যি ছিল সেই এক রাতের নির্জনে
সেই দিব্যজ্যোতিস্নানে আঁধারও কি ছিল সন্তর্পনে?

বৃষ্টিভেজা সেই জ্যোৎস্না রাতে
দুজনের হাতে হাত রাখা দুটি হাতে
ছিল জেগে রাত ছিল পালঙ্ক পৃথক
কথা গানে জেগে ছিল স্বপ্নদেখা ভূস্বর্গের ছক।

সত্যি হয়ে ওঠা স্বপ্ন হাতে
কবিতা পাঠের সেই কল্পস্বর্গ রাতে
কথাশিল্পকলা আর গান আর ছবি
ওরা দুজনই যে ছিল একাধারে শিল্পী আর কবি।

কবিগুরু স্বয়ং অতিথি
সেই রাত ছিল এক অশেষ সঙ্গীতই
ছিলেন হাছন রাজা লালন ফকির
ছিল বটবৃক্ষচ্ছায়া ছিল অবারিত নদীতীর।

দুঃখরাত ছিল না অশেষ
গৃহটাও থাকেনিকো আর এক দেশ
ভেঙে গিয়েছিল দুইভাগে একই ঘর
দুই পারে দুই একা মাঝখানে ভূমধ্যসাগর।

এটুকুই আজ সব কথা
এটাই আমার নিরুদ্দিষ্ট পথিকতা
পূর্বদিনান্তের অমৃততৃষ্ণার গান
কী আর গাইবো আমি প্রাণদণ্ডাদিষ্ট প্রত্নপ্রাণ?

রেজা রহমান
কবি গবেষক ও উন্নয়নকর্মীাহল

Exit mobile version