জলেশ্বরী

যদি তোমার দেখা পাই

তোমার নাকি ইচ্ছে করে জীবন সংসারের চক্রাকার ঘানির জোয়াল ফেলে দূরের কোন গাঁয়ে বসতি গড়তে। সেখানে ছনপাতার একটু ছাউনি থাকবে মাথার উপর। সে ঝুপরি ঘরের কলাপাতার বেড়ায় গুজিয়ে রাখা থাকবে সুপারীপাতার বাকলের হাতপাখা। জ্যোৎস্না রাতে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে চাঁদনীর আলো তোমার শরীরে পড়বে আর অন্ধকারে জোনাকীরা তারার মতো ঘরময় মিটমিট করে আলো দেবে। সারাদিন তুমি নদীতে মাছ ধরবে। সন্ধায় মাছ নিয়ে বাজারে যাবে কয়েকটা মাছ ঘরের হাড়িতে রেখে। মাছ বেচে তুমি চাল, নুন কিনে ঘরে ফিরবে।

তোমার আরো নাকি ইচ্ছে করে কোন পাহাড়ে চলে যেতে যেখানে এখনও কোন মানুষের পা পড়েনি। সেই পাহাড়ের বড় কোন উঁচু ডালের উপর তুমি ডালপালা দিয়ে মাচা বানাবে।সারাদিন পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে লতা-পাতা, ফলমুল জোগাড় করবে। সন্ধায় পেটপুরে খেয়ে মাচায় শুয়ে গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়বে।

তোমার ইচ্ছে করে কোন অচিন জঙ্গলে চলে যেতে যেখানে আজো কেউ বসতি গড়েনি। তুমিই প্রথমে জঙ্গলের ধারে বসতি গড়বে। আদি মাটিতে কোদাল চালিয়ে ফসল ফলাবে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের অঙ্কুরোদগম দেখবে, ফসলের বাড়তে থাকা দেখবে, ফসলের মায়ের গর্ভবতী হতে দেখবে, দেখবে বীজের পূর্ণজন্ম।

আবার কখনও তুমি হতে চাও দাঁড় ধরে বসে থাকা কালো কাকের ছবির মতো ঘাটের মাঝি, কখনওবা একতারা হাতের গেরুয়া বাউল। আবার ব্যালকনিতে সকাল-বিকেল বেড়াতে আসা শালিক জোড়াকে দেখে দেখে তোমার শালিকও হতে ইচ্ছে করে। শালিকের মতো নির্ভার নির্লিপ্ত জীবনে টুপটুপ ঝুপঝুপ কবিতার মতো ওড়া-চলা করতে তোমারও অনেক সাধ।

কিন্তু তোমার ইচ্ছেগল্পের নায়ক হওয়া হয় না কখনও। তোমার সুখি হওয়াও হয় না। কল্পনার এই সুখ তোমার বাস্তবতায় শান্তি না দিলেও স্বস্তি দেয়। যখন তোমার ঘরের দামী আসবাবের মাঝে দমবন্ধ লাগে এসির ভারী বাতাসে, তুমি জঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখে নির্মল বাতাসে শ্বাস নাও। যখন শহুরে হৈহুল্লোড়ে অস্থির লাগে, তুমি পাহাড়ের গায়ের নির্জনতা খোঁজো। যখন সংসারের হিসেব-নিকেশ ও চাহিদার মাঝে হিসেব মেলাও, তখন তুমি স্বপ্নের নাও গাঙে ভাসিয়ে বাস্তবতার কুলে ফেরো।

মানুষ মানেই নাকি কল্পনা করতে ভালবাসে, তুমিও। রা্জপ্রাসাদে থাকা রাজকুমারীও কল্পনায় রাখালের সাথে ঘুরে বেড়ায়। এই গোপন ভাললাগায় কোন বাঁধা নেই। নেই সামাজিক অনুশাসন। সবাই কল্পনার ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায় জগতময়। ল্যাম্পপোষ্টের ঠিক মাথাটায় শালিক হয়ে গিয়ে বসতে কোন কষ্ট হয় না কারো। কল্পনার কোদালে মাটি খুড়ে ফসল ফলাতে কোন ঘাম ঝরে না। সকলেই হয়তে তাই কল্পনা সুখের বিলাসী। কল্পনা করতে করতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতার স্বপ্নগুলোর সাথে কল্পনার স্বপ্নগুলোর বিস্তর ফারাক।

বাস্তবতায় তুমি নিজের কল্পনার বাইরের এক দানবমুর্তি। দম নেওয়ার ফুরসত নাই তোমার বলে তুমি মাঝে মাঝে ভুলেই যাও দম নিতে। দমের বাতাস না পেয়ে যখন হৃদপিন্ডটা থেমে যাওয়া শুরু করে তুমি হাসফাস করে তখন দম নাও। তোমার খাওয়ার সময় নেই, ঘুমের সময় নেই, ভালবাসার সময় নেই। পুরোটা সময় তোমার দখলে নিয়েছে কঠিন বাস্তবতার স্বপ্ন। এই স্বপ্নে তোমার কোন বিলাস নেই। শুধু যে কোন মূল্যে লক্ষ্য অর্জন তোমার চাই-ই চাই।

বাস্তবতায় শহরের সবচেয়ে বিলাসী পাথরের বিশাল বাড়িটা কেন তোমার থেকে এতো দূরে? হাত পা ছড়িয়ে আয়েশে বসা দামী গাড়িটার চাবি কবে থেকে হাতে ঝুলবে? ব্যাংকে কত সংখ্যার হিসেব থাকলে সারা জীবন রোজগারের ছোটা-ছুটির অনিশ্চয়তা থাকবে না? পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে এতটুকু তোমার বাস্তব লক্ষ্য।

এই বাস্তবতার স্বপ্ন তোমার কল্পনার ঝাঁপিকে আড়াল করে রাখে। তুমি স্বপ্ন ও বাস্তবতায় হয়ে ওঠো এক দ্বান্দ্বিক মানুষ। এই দ্বন্দ্ব তোমার কল্পনার পায়ে জিঞ্জির পরায়। তোমাকে বন্দি করে। তুমি বেড়িয়ে আসতে চাও। শান্তিতে দম ফেলতে চাও। কিন্তু তোমার দম আটকে থাকে। তুমিও আটকে থাকো বাস্তবতায়।

লাইলী ইয়াসমীন
লেখক- সাংবাদিক

Exit mobile version