জলেশ্বরী

লেখক হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করিনি

oplus_50

রহিমা আক্তার মৌ::

১. আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে এবং কীভাবে হলো?

উত্তর: ২০০২ থেকে ২০০৮ ব্যক্তিগত জীবনে অদেখা ঝড়। মনে হচ্ছিলো মাঝ নদীতে সাঁতার কাটছি। কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুব নিষ্ঠুর পরিকল্পনাও ভেবেছি, সাথে সুন্দর একটা পথ খুঁজছি। কিন্তু সেটা কি, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। ২০০৮, মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার পথে পত্রিকার দোকান থেকে পড়ার জন্যে কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে আসি। পড়তে থাকি, কিছু লেখার সাথে লেখকদের মোবাইল নাম্বার পাই। তাদের সাথে কথা বলে জিজ্ঞেস করি, “লিখলেই কি পত্রিকায় ছাপা হয়?”। ওনারা জানালেন, “পছন্দ হলে ছাপায়”। আমি শুরু করলাম মন দিয়ে পড়া। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করি, চারপাশের সমস্যা নিয়ে পত্রিকার চিঠিপত্রের কলামে ছোট ছোট লেখা পাঠাতে শুরু করি। এই ভাবেই লেখালেখির শুরু ২০০৯ সালে।

২. গল্প, কবিতা, ও প্রবন্ধের মধ্যে কোন ধারাটি আপনাকে বেশি আকর্ষণ করে?

উত্তর: স্কুল কলেজ কবিতা পড়তে ভালো লাগতো। ভালো লাগা কিছু কবিতা নিজের নোটখাতায় লিখেও রেখেছি, কিন্তু কবিদের নাম সাথে লিখিনি। নিজেও ২/৪ টা মনের কথা লিখেছি। একটা সময় নোটখাতা বের করে আর বুঝতে পারিনি কোনটা আমার লেখা কোনটা কবিদের। ২০০৯ সাল থেকে যখন পড়তে পড়তে লিখতে শুরু করি তখন বুঝলাম গদ্য (গল্প, কলাম, প্রবন্ধ, ফিচার)ই আমাকে টানে খুব। আর পদ্য (কবিতা, ছড়া)লেখা খুব কঠিন। পদ্যকে আমি বাংলা সাহিত্যের সারমর্ম বলি আর গদ্যকে বলি ভাবস্পোসারণ। ২০০৯ সালে প্রায়ত সিনিয়র সাংবাদিক সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্যার বলেছিলেন আমার লেখায় আবেগ অনেক। আবেগ দিয়ে গদ্য লেখাই সহজ। গদ্য আমাকে আকর্ষণ করে আর গদ্য লিখতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

৩. জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা কেমন?

উত্তর: বরাবরই জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় লিখছি আমি। জাতীয় পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে আনন্দ বেশি হয় কারণ এই পত্রিকা দেশ-বিদেশের পাঠকরা পড়ে, পরিচিতি সেভাবে হয়। স্থানীয় পত্রিকা আবার আমাদের জেলা বা মফস্বলের পাঠকদের কাছে পৌছায়। ওনারা খুব যত্ন করে পড়ে আবার সংগ্রহেও রাখে। লেখা প্রকাশের অনেকদিন পর যখন কেউ লেখার সমালোচনা করেন অনেক আনন্দ লাগে। একটা সময় লেখা প্রকাশের সময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা এলাকা দেখতাম না। লেখা প্রকাশিত হবে এটাই মাথায় ছিলো। স্থানীয় পত্রিকা থেকে যখন লেখা চায় তখন নিজের প্রতি আস্থা বাড়ে এই বলে যে উনারা আমাকে চেনেন, আমার লেখা ছাপাতে চান। আবার এমনও দেখেছি জাতীয় পত্রিকায় লেখা প্রকাশের পর স্থানীয় পত্রিকায় সেই লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তখনও আনন্দ পাই।

৪. লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোতে আপনি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ পান?

উত্তর: যখন কেউ লেখালেখি শুরু করে তখন যা মনে আসে তাই লিখতে থাকে। আমিও তাই করেছি। পত্রিকার প্রায় সব বিভাগেই আমি লিখেছি তাই ইস্যু পেলেই কোন বিভাগে কি লিখতে হবে তার উপর লেখা রেডি করি। একটা সময় সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখেছি খুবই, সেটা কলাম হোক বা প্রবন্ধ বা ফিচার হোক। করোনার পর অনেক পত্রিকা বন্ধ, অনেক পত্রিকার পেইজ কমে যাওয়ায় সমসাময়িক লেখার জায়গা কমে গেছে বলে সেসব কম লিখি। দিবস ভিত্তিক লেখা লিখতে আগ্রহ পাই, কারণ লেখা আগেই রেডি করা যায়। আমরা যারা সংসার সামলে লেখালেখি করি তারা চাইলেই সময় বরাদ্দ রাখতে পারিনা লেখালেখির জন্য, তাই আগে আগে রেডি করতে হয় আমাদের। মোট কথা একটু সময় নিয়ে বিষয়ভিত্তিক লেখার উপর আমার দুর্বলতা। বিভিন্ন পেশার নারীদের নিয়ে বেশ কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে।

৫. কোন লেখক বা ব্যক্তিত্ব আপনাকে লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত করেছেন?

উত্তর: লেখালেখির বিষয়ে বলতে গেলে আমি সবসময় যার কথা বলি আর বলবো, তিনি হলেন রংপুরের সালমা সেতারা আপা। সেই ২০০৯ থেকেই উনার সাথে আমার যোগাযোগ। উনি আমায় বলেছেন, “মৌ, গল্প কবিতা চিরকাল তোমার থাকবে। তবে পাঠকের কাছে যেতে হলে তোমাকে বিষয়ভিত্তিক লেখা লিখতে হবে।” আপার এই কথা আমার জীবনের উৎসাহ। আসলে লিখতে হলে পড়ার বিকল্প নেই। দৈনিক পত্রিকার কলাম পড়ে পড়ে কলাম লেখা শিখেছি আমি। সত্যি বলতে লেখক হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করিনি। আমি পড়তে পড়তে লেখক হওয়ার চেষ্টা করছি। কোন ব্যক্তি নাম সেভাবে বলবনা। তবে যা লিখতে চাই তা পড়তে হবে অনেক। বাংলা সাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন আপার সাথে যখনি দেখা হয়, আমার লেখালেখির বিষয় শুনে আপা বলেন, “সবাইকে যে গল্প, উপন্যাস লিখতে হবে এমন নয়, তুমি যে কাজগুলো করছো এগুলো চিরস্থায়ী কাজ।” ২০২৪ সালে প্রথম উপন্যাস আসে আমার। উপন্যাস শুরুর আগে কয়েকটি উপন্যাস পড়েছি, সেটা প্রতিষ্ঠিত লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখকদের। বুঝেছি উপন্যাস লিখতে হলে আরো অনেক উপন্যাস পড়তে হবে আমায়।

৬. আপনার লেখায় সমাজের কোন বিষয়গুলোকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেন?

উত্তর: সত্যি বলতে বরাবরই নারীরা সব দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। আমি সব ইস্যু নিয়ে লিখলেও দিনশেষে দেখছি নারীদের নিয়ে লেখা আমার বেশি। নারীদের যাপিত জীবন, সমস্যা এসব নিয়ে শতশত ফিচার কলাম লিখেছি, তবে ক্ষেত্র ভিন্ন। প্রেমভালবাসা নিয়ে অনেকেই লিখেন, আমিও লিখি। তবে আমার মনে হয় লেখায় অন্তত একটা টিপস যদি দেয়া যায় পাঠকের জন্য। আমার একটা লেখা ১০০ জন পড়ার পর যদি একটা টিপস একজনের কাজে আসে সেটাই সার্থকতা। লেখালেখির ১৫ বছরের মাথায় এসে দেখছি সমাজ পরিবার, দেশ প্রায় সব বিষয় নিয়ে কিছু হলেও লিখেছি। তবে এটা বুঝি সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে সময়ের সাথে, আমাদেরকেও লেখায় পরিবর্তন আনতে হবে সময়ের সাথে তাল রেখে।

৭. আপনার লেখা প্রথম কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেই সময়কার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

উত্তর: আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ইত্তেফাক গ্রুপের সাপ্তাহিক রোববার ম্যাগাজিনে। সেটা ছিলো “নর ও নারী” শিরোনামে কবিতার মতো কিছু। সেদিন আমি ১০টি সংখ্যা কিনেছি। পরিচিতিদের দেখিয়েছি, দিয়েছি। একটা ম্যাগাজিন সবসময় সাথে থাকতো, সবাইকে দেখাতাম যে ছাপার অক্ষরে আমার নাম পত্রিকায়। সাপ্তাহিক নামের ম্যাগাজিন, সাপ্তাহিক ২০০০, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক জনকণ্ঠ এসব পত্রিকায় প্রথম দিকে লেখা বেশি প্রকাশিত হয়েছে। তখন ফেইসবুক ছিলো না, লেখা প্রকাশ পেলেই একটা ম্যাসেজ লিখে পরিচিতদের জানাতাম। সম্ভবত ২০০৯ বা ১০ সালের ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ এ আমার একটা লেখা ছাপা হয়। ৮০/৮৫ টাকা দিয়ে সংখ্যাটা কিনেছি। সেই টাকা জোগাড় করতে খুবই কষ্ট হয়েছে। আর এখন হাজার শব্দের লেখা প্রকাশ পেলেও পত্রিকা কিনি না। তখন যাদের সাথে আমার লেখা ছাপা হতো তাদের অনেকেই নেই এখন লেখালেখিতে।

৮. পাঠকদের কাছ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পান?

উত্তর: পাঠকের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে লেখার বিষয়ের উপর। আর প্রতিক্রিয়া ফেইসবুক টাইমলাইনে লাইক কমেন্টের সাথে যারা ইনবক্সে আলোচনা সমালোচনা করেন ভালো লাগে। মজার বিষয় অনেক পুরাতন লেখা পড়ে কেউ কেউ কল দেন সেটা এনজয় করি। লেখকদের জন্য বিশাল প্রাপ্তি গুগুলে অনেক লেখাই থাকে। পাঠক সেখান থেকে লেখা পড়ে ফেইসবুক আইডি বের করে বলে, “আপনিই কি সেই লেখক” এমন যোগাযোগগুলো অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে। কেউ কেউ আমার লেখার পত্রিকার কাটিং জমা করতেন। এতো বছর পর ফেইসবুকে খুঁজে পেয়ে সেসব পাঠাচ্ছেন। এসব দেখে চোখে জল এসে যায়। মজার বিষয় লেখকদের পরিচিত শুধু একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়, তাদের নামেই তাদের বিশ্বব্যাপী পরিচয়।

৯. ভবিষ্যতে আপনার কোনো নতুন লেখার পরিকল্পনা আছে? নতুন কোনো বই নিয়ে কাজ করছেন কি?

উত্তর: আসলে আমার লেখার বিষয়গুলো একটু ভিন্ন, বলতে গেলে ভিন্ন ধরনের বই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারটা বই। শিশুতোষ গল্পের বই, বড়দের গল্পের বই, প্রবন্ধের বই। নারীদের নিয়ে কাজ করেছি আর চলমান আছে। ‘একাত্তর ও নারী’ বইটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয়তা ছিলো অনেক। কলাম প্রবন্ধের পাশাপাশি আমি ভাষাকন্যাদের নিয়ে কাজ করছি, কলমকন্যাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ২০২৪ সালে ভাষাকন্যারা বইটি এসেছে। ২০২৫ সালের জন্য আমার ২৫ তম বই, ২৫ কলমকন্যাকে নিয়ে লেখা পাণ্ডুলিপি জমা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন ভাবে আবার আসছে ‘একাত্তর ও নারী’ বই, জমা দেয়া হয়েছে শিশুতোষ গল্পের দুইটা পাণ্ডুলিপি। ২০২৫ সালে আমার অন্য একটা বিশেষ কাজ আসবে সেটা হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজেরা নজরুলের সাথে আমার সাক্ষাত হয় কিছুদিন আগে। উনি উনার দুইটা বই আমাকে উপহার দেন। একটা গল্পের আরেকটা কবিতার। এই বই দুটির শেষ কপি এগুলো। হাজেরা খালাম্মার অনুমতি নিয়ে এই দুই বই আবার নতুন করে পাঠকদের জন্য আমি মেলায় আনার দায়িত্ব নিয়েছি। বইয়ে আমি কিছু লিখছি না। উনার বই গুলো শুধু দায়িত্ব নিয়ে আনবো। এই প্রজন্মের পাঠক যেনো উনার লেখাগুলো পড়তে পারে। নতুন আরো কিছু কাজের কথা ভাবছি, তা বলছি না আপাতত। আপাতত প্রকাশিত বই ২১ টি।

১০. যারা নতুন করে লেখালেখি শুরু করতে চান, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

উত্তর: যে যে বিষয় নিয়ে লিখতে চায়, সে বিষয়ে বেশি পড়তে হবে। যে পত্রিকার যে বিভাগে লিখতে চায় সেই পত্রিকার সেই বিভাগের লেখা বেশি বেশি পড়তে হবে। লেখা প্রকাশিত হবেই এমন মনোভাব দূর করতে হবে। আজ লেখা পাঠাচ্ছে, বিভাগীয় সম্পাদক পড়ছে। লেখা প্রকাশিত না হোক তার নাম তো সম্পাদকের চোখে পড়েছে। লেখা প্রকাশিত হয়নি মানেই যে লেখা হয়নি তা নয়। পড়তে থাকো, লিখতে থাকো, পাঠাতে থাকো। সব লেখার সাথে নিজের চলমান মোবাইল নাম্বার দিবে, এতে করে বিভাগীয় সম্পাদক তোমায় খুঁজে পাবে। একটা লেখা এক পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি বলে মন খারাপ করা যাবে না। অন্য পত্রিকায় ছাপা হতে পারে। আর এক লেখা একই সাথে কয়েক পত্রিকায় না দেয়াই উত্তম।

১১. লেখালেখিতে সফল হতে গেলে কী কী গুণাবলী থাকা জরুরি বলে মনে করেন?

উত্তর: পড়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ধৈর্য থাকতে হবে। নিজে যা পারে না তা সহজে স্বীকার করার মানসিকতা থাকা। যে ধরনের লেখায় আগ্রহ সেই ধরনের লেখা বেশি পড়া।

লেখকঃ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

Exit mobile version