লাইলী ইয়াসমীন::
বিছানা থেকে এক লাফে উঠে দাঁড়ায় মাসুদ। দরজার ছিটকিনিতে হাত দিয়ে কি যেন ভেবে আবার পিছন ফিরে তাকায়। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার নামটা যেন কি?’
ক্লান্ত আধবোঝা চোখ কিঞ্চিত তুলে অস্পষ্ট জবাব দেয় সে- ‘মালা’।
‘ওহ মালা, তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর! কোনদিন বলা হয়নি তোমাকে। আজ তোমার ঘরে একটু বসি? যেতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।’
এবার শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বিছানার একপাশে বসে মালা। অযাচিত আবদার রেখে বলে, -‘বসেন’।
মাসুদ কি যেন ভেবে আবার বলে, ‘থাক। চলেই যাই। ভাল থেকো তুমি।’
মালা কিছুটা অপ্রস্তুত হয় মাসুদের কথায়। ২২ বছরের এই জীবনে এমন করে ভালো থাকতে বলেনি কেউ কোনদিন। মাসুদও অনেকবার এসেছে এই ঘরেই। প্রয়োজন শেষে মুখ না ফিরেই হন হন করে চলে গেছে। কোনদিন নামটাও জানতে চায়নি। আজ হঠাৎ ? লোকটার নিশ্চয় কোন গোলমাল হয়েছে! নইলে মালাদের কেউ নাম জানতে চায় নাকি? আর তাদের কি সত্যিকার কোন নাম থাকে? বাপ-মায়ের দেয়া নাম তো এই ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ভুলিয়ে দেয়া হয়। বাকী জীবন কাটে খালার দেওয়া নতুন কোন নামে। তখন কুঠরি ঘরটার দরজার ওপাশে হাপিত্যাস করে বাবা-মায়ের দেয়া সেই নাম। সে নামের আর্তনাদ পৌছায় না আর মালাদের কান অবধি। এক সময় সত্যিকারের নামটা ঝাপসা হতে হতে মুছে যায়।
অনেকদিন পর আজ মালার মনে পড়ে তার মা-বাবার দেয়া নাম। কত আদর করে বাবা ডাকতো তাকে সোহাগী! বাবা হাট থেকে ফিরে বাজারের ব্যাগটা মায়ের হাতে দিতে দিতে ডাকতো ‘সোহাগীরে, তোর জন্য মিঠাই আনছি রে মা, তুই কই?’ সোহাগী দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত থেতে মিঠাই নিতো। একমাত্র মেয়ে ছিল সে। মা কি কম আদর করতো? চাঁদনি রাতে আকাশের চাঁদটার দিকে দেখিয়ে বলতো, ‘চান্দটার চাইতে কত্ত সুন্দর আমার সোহাগী!’ মালা ভাবতে ভাবতে সে সব দিনে হারিয়ে যায়। যেন একবার মালা থেকে সোহাগী হয়ে ওঠে। তার চোখের কোণায় একফোঁটা জল বেরিয়ে আসে জননীর জরায়ু ফেটে ভুমিষ্ট হওয়ার যন্ত্রণা দিয়ে। ২২ টি বছর এই একফোঁটা তপ্ত জল নিয়ে অন্তসত্তা ছিল যেন তার চোখ! আজ প্রসব বেদনা দিয়ে ভুমিষ্ট হল কপোলে।
খালা এসে দরজার বাইরে সজোরে ধাক্কা দেয়, ‘মা-লা! এই মাগী, এক হারামীরে নিয়া এতক্ষণ পড়ে থাকলে তোর তিন বেলার ভাত জুটবে? জলদি শাড়ি পইরা রাস্তার মোড়ে গিয়া দাঁড়া। খরচাপাতির যা দাম পড়চে, লিপস্টিকের দামটাই তো আইজ তুলতে পারিস নাই! এত্তো আয়েশ তোর!’
ডাকটা যেন তীর হয়ে বুকে বিঁধে যায় মালার। হকচকিয়ে উঠে সে। পাতলা শাড়িটার এক প্যাঁচ বুকে জড়িয়ে ঝটপট নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক লাগিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে আবার রাস্তায় দাঁড়ায়।