এক.
২০১৭ সাল থেকে আমরা যেখানে যে প্রোগ্রামেই যাই না কেন ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’ প্রবাদটি মাথায় রাখি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না ভেবে পরের দিন ২৮/০৮/২০২১ তারিখ সিলেটের শীর্ষ আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার প্ল্যান করি। সামাদ ভাই রাতের প্রোগ্রাম শেষে কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় আমরা ৩জন পরবর্তী সফরের জন্য রেডি হই। সকালবেলায় একটি সিএনজি রিজার্ভ করে রাতারগুল চলে যাই। নয়নাভিরাম এসব দৃশ্য দেখে কার না প্রকৃতির সান্নিধ্যে বারবার আসতে মন চায়। অধ্যক্ষ আব্দুস সোবহান স্যারের সাথে এবারে আমার প্রথম সফর। তাই তার মন-মর্জি অনেকটাই অজানা। আর সাখাওয়াত সাহেবের সাথে ইতিপূর্বে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, দর্শনা, মুজিবনগর ও ঝিনাইদহ ভ্রমণ করেছি। তাই তার মন-মানসিকতা আমার জানা আছে। ভ্রমণে একই মনের লোক না হলে ভ্রমণ আনন্দদায়ক হয় না। এজন্য ভ্রমণে সবসময় একই মন-মানসিকতার লোক-সঙ্গী হওয়া চাই। একসাথে ভ্রমণ না করলে মানুষ চেনা যায় না, এমন প্রবাদ আমার আগে থেকেই জানা আছে। তাই রাতারগুলে সে পরিচয় পেয়ে যাই। বুঝতে পারি এদেরকে নিয়ে ভ্রমণ করা কোনো সমস্যা হবে না। যদিও দুজনেই বয়সে আমার সিনিয়র কিন্তু দুজনেই আমরা সিদ্ধান্তে বেশ শ্রদ্ধাশীল। কিছুটা বাড়তি চাপ অনুভব করছি তখন। যাইহোক ভ্রমণ আনন্দঘন করতে হবে এবং সাথিদেরকে আনন্দ দিতে হবে এই ভাবনা নিয়ে পথচলা শুরু হল। রাতারগুলের ভোরের আকাশটা তখন ভীষণ রকমের রোমান্টিক, সারি সারি নৌকা সাজানো। ঘুরে দেখার জন্য নদীমাতৃক এলাকায় আমার ও সোবহান ভাইয়ের জন্ম হওয়ার কারণে এসব নতুন কিছু না হলেও প্রকৃতির অপূর্ব দান দেখার বেশ একটা আগ্রহ আছে আমাদের মাঝে। কিন্তু সকালবেলা মনটা খারাপ হয়ে গেল নৌকার সিন্ডিকেটের কথাবার্তা শুনে। এসব জায়গায় সবাই গ্রুপ বেঁধে ঘুরতে যায়, সেখানে আমরা মাত্র ৩জন। নৌকা নিতে হলে পুরো টাকা পেমেন্ট করতে হবে। ৩জন গেলেও ৮ জনের ভাড়া গুণতে হবে। চাইলেও অন্য কোনো গ্রæপের সাথে যুক্ত হতে পারছি না। স্থানীয় দালাল বাধা দিচ্ছে। শুরুতেই বিড়ম্বনায় পড়ে মনটা ক্ষণিকের জন্য খারাপ হয়ে যায়। জায়গাটা দেখে মনে হলো, এমন দৃশ্য জীবনে অনেক দেখেছি। যেহেতু আমাদের মূল আকর্ষণ বিছানাকান্দি ও ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। একদিনে ৩টি স্পট ঘুরে দেখা সহজ হবে না, যদি না আমরা খুব তাড়াহুড়ো করি। তাই কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করে বিছানাকান্দির দিকে ছুটে চলা। মনে মনে ভাবলাম এত কাছে এসেও ভিতরটা ঘুরে দেখতে পারলাম না। কিন্তু মুহ‚র্তেই মনে হল আমাদের হাতে সময় কম, তাই দ্রæত পথচলা শুরু হলো আবার। অনেকটা পথ পেরিয়ে যখন বিছানাকান্দি গিয়ে নৌকা ঘাটে পৌঁছে যাই, তখন আবার নৌকা সিন্ডিকেটের কথা মনে পড়ে। ওখানেও একই অবস্থা। দালালচক্র আগের চেয়ে আরও সক্রিয়। স্পট থেকে ভারতের সীমানায় অবস্থিত ঝর্ণা বেশ সুন্দর লাগছিল। সবাই এক এক করে এখানে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছি। স্থানীয়ভাবে তৈরি সিঙ্গাড়া-সমুচা আর পিঁয়াজু বেশ মজা লেগেছে। কিন্তু ফুটবলটা যে কয়েকবার লাথি মেরেছি তার বিনিময় ৩০ টাকা গুনতে হয়েছে। টাকা যেহেতু দিতেই হবে তাই এবার গ্রুপের একজন শেষ লাথি মেরে বলটাকে পাঠিয়ে দিল নদীতে। সে দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব ছিল। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম শিশুকালের সেই নদীর পাড়ের ফুটবল খেলার মাঠে। রাগের মাথায় কত যে ফুটবল নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি তার হিসাব নেই।
এবার শুরু হলো বিছানাকান্দির অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য পথচলা। আমরা যে নৌকায় এসেছি তার পুরোটা জুড়ে এখন আনন্দের জোয়ার। নদীতেও জোয়ার লেগেছে আমাদের সাথে। তুফান আর জোয়ারের মেলবন্ধনে আমরা হারিয়ে যাই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে। মনে পড়ছিল-
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।
আমাদের গ্রুপের ছেলেগুলো বেশ ভালো। একজন আমার বাসার কাছেই থাকে। ওদের ক্যামেরায় ধারণ করেছে আমাদের অনেক ছবি। আমার ছবি তোলার সময় কেউ কেউ বলেছে, আঙ্কেলকে তো পুরো নায়কের মতো লাগে। আমি জানি এসব ক্যামেরায় কারসাজি, বাস্তবে আমি কেমন তা আমার অজানা নয়। যাইহোক, ইয়াং ছেলেরা আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে এতে আমি খুশি। বিছানাকান্দির অনেক গল্প শুনেছি। এবার সরাসরি দেখার পালা। নৌকা যত কাছে আসছে ততই পাহাড়ের রূপ ঝলসে পড়ছে আমাদের ওপর। বিকালের সূর্যরশ্মি আর পাহাড়ের সবুজায়ন রূপে রূপে একাকার অবস্থা। প্রকৃতিপ্রেমী মাত্রই এই দৃশ্য দেখে আর অলস বসে থাকতে পারবে না। মুহ‚র্তেই সকলের ক্যামেরা অন হয়ে গেল। ভালোবাসার দৃশ্যগুলো ক্ষণিকের জন্য ক্যামেরাবন্দি করা হলো। নৌকাতেই সবাই হুড়মুড় করে নামছে আর বিছানাকান্দির পানি আর পাথরের স্পর্শে দ্রæত ছুটে চলছে। আমাদের ৩জনের কারও যদিও পানিতে নামার কোনো প্ল্যান ছিল না। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অবিচল থাকা সম্ভব হয়নি। শুরুতে আমার সঙ্গীরা স্বচ্ছ পানি আর সাদা পাথরের আকর্ষণে হাঁটু পানিতে শরীর সতেজ করার খেলায় মগ্ন হয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর সামাল দিতে পারিনি। প্রস্তুতি ছাড়াই শার্ট-প্যান্ট পরা অবস্থায় নেমে পড়ি পাথরের আকর্ষণে। এরই মধ্যে চলতে থাকে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ। সামান্য পানিতে নেমে কাপড় না ভিজিয়ে উঠে যাব ভেবেছি। কিন্তু মুহ‚র্তেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না, শ্যাওলাযুক্ত পাথরে পা রাখার সাথে সাথেই ধপাস করে পড়ে গিয়ে পানিতে ভিজে একাকার অবস্থা। আমার পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীরা খানিকটা মজা পেয়েছে মনে হলো। কিন্তু ইতোমধ্যে সামান্য আঘাতে পায়ে ব্যথা পেয়েছি, হাতের অবস্থাও ভালো না। স্বচ্ছ পানিতে হাতের মোবাইল ফোন কখন যে পড়ে গেল তা নিজেও টের পাইনি। সঙ্গীদের ইশারায় বুঝতে পারলাম,আমার সেলফোনের সলিল সমাধি হয়েছে। ফোন খুঁজে পাওয়া গেল ঠিকই কিন্তু তাকে আর সুস্থ অবস্থায় পাওয়া গেল না। মন খারাপের রাজ্যে প্রবেশ করলাম সাথে সাথে। সোবহান ভাই আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, আমার ঘড়িটাও পানিতে পড়ে গেছে। এবার ৩জন মিলে ঘড়ি খোঁজা করেছি। ঘড়ি যে আগেই আমি প্যান্টের পকেটে রেখেছি, তা আমার আর খেয়াল নাই, হন্যে হয়ে ঘড়ি খুঁজে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ খোঁজার পর যখন ফিরছিলাম তখনই মনে হলো একবার পকেটে হাত দিয়ে দেখি ঘড়ি আছে কিনা। যাক, এবার পকেটটা অন্তত আমাকে নিরাশ করেনি কিন্তু মোবাইলের চিন্তায় অস্থির। কিছুক্ষণ পর বিছানাকান্দিকে বিদায় জানানোর ঘোষণা এলো আমাদের গ্রুপ লিডারের কাছ থেকে। তাই এবার দুপুরের খাবার গ্রহণের পালা। সাখাওয়াত স্যার আগে থেকেই অস্থায়ী হোটেলের সাথে চুক্তি করেছেন জনপ্রতি খাবার খরচ মাত্র ১০০ টাকা। নদীর পাড়ের অস্থায়ী হোটেলের পরিবেশ তেমন একটা ভালো না। তবুও তপ্ত দুপুরে ভুখা পেট বলে কথা। আমরা খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি বেশ কিছু আইটেম দেয়া আছে। ১০০ টাকায় ডাল-ভাত তো আনলিমিটেড আছেই। বিছানাকান্দি ঘুরতে এসে অন্যসব স্থানে অনেক হয়রানির শিকার হলেও এখানে খেতে বসে সবাই খুশি। কারণ সারাদিন ভ্রমণের পর সবাই অল্প টাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে পারছে। সবার মুখে হাসির ঝলক লক্ষ করলাম। হাওরের তাজা মাছের স্বাদ নিশ্চয় সকলের মনে থাকবে। খাবার শেষে ফিরতে হবে নৌকায়, যেতে হবে ভোলাগঞ্জের মনভোলানো সাদা পাথর দেখতে। তাই হাতে খুব বেশি সময় নাই। কিন্তু কারোরই এখান থেকে ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। এখানে আরও কিছুটা সময় থাকতে পারলে মনে হয় সময়টা ভালোই কাটত। নৌকায় চড়ে সবাই পোশাক পরিবর্তনে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত পোশাক নেয়া হয়নি, তাই প্রকৃতির হিমেল হাওয়া আর তপ্ত রোদ্দুরই একমাত্র ভরসা। নৌকা চলছে, গান বাজছে আর প্রকৃতি ডাকছে। এমন করে করে খুব অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
দুই.
এবার যাত্রা শুরু হলো ভোলাগঞ্জের দিকে। ওখানে সাদাপাথর দেখার ইচ্ছা আর পাহাড় তো আছেই। গাড়ি চলছে কিন্তু শেষ হচ্ছে না। মাঝপথে ড্রাইভার বেঁকে বসে, তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে নাকি সন্ধ্যাবেলায়। যদিও আমাদের সাথে কথা ছিল, আমরা আজকে ৩টি স্পট দেখে ফিরতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ সে আমাদের সাথে থাকবে। কিন্তু মাঝপথে এই বিড়ম্বনা দেখে আমার মেজাজ বেজায় বিগড়ে যায়। যাইহোক, অনেকক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের দেশে। সারাদেশে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণ সাদা পাথর সাপ্লাই দেয়া হয়। সাদা পাথর দেখতে হলে এখানেও নৌকা ভাড়া নিতে হবে। তবে এখানের নিয়মটা ভালো, অন্যান্য জায়গার মতো খামখেয়ালিপনা নেই। অনেকটা সামর্থ্যরে মধ্যে নৌকার টিকিট কেটে উঠে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কাক্সিক্ষত সাদা পাথরের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। বিছানাকান্দির সাথে অনেকটাই মিল আছে। সৌন্দর্য্যরে দিক বিবেচনা করলে আমার কাছে বিছানাকান্দিই বেস্ট। তারপরও পড়ন্তবেলায় সূর্যের আলো আর পাথরের লুকোচুরি বেশ ভালোই লাগছিল। পাশেই কাঁটাতারের বেড়া, ইন্ডিয়ান বর্ডার। যা দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায় সকলের। পাহাড়ের সম্পদ ও সৌন্দর্য পুরোটাই নিয়েছে ইন্ডিয়া। আর আমাদের জন্য সন্তুষ্টিসূচক বন্ধ্যা, সন্তানহীন বালুকাময় একখণ্ড ভূমি রেখেছে। খুব বেশি সময় পাইনি এখানে সময় কাটানোর। তাই সন্ধ্যার সাথে সাথেই সিলেটে ফেরার তাগাদা। নৌকায় মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। গোধূলি সন্ধ্যার আকাশটা বেশ ভালোই লাগল। সময় হাতে থাকলে আরও কিছুটা সময় নদীতে কাটাতে পারলে অধিক স্মরণীয় হয়ে থাকত।
এবার সিলেট শহরে ফেরার পালা। ড্রাইভারের মন খারাপ, কারণ অতিরিক্ত কিছু ধান্দা করতে পারবেনা এই ভেবে। তবুও চলছে সিলেট শহরের দিকে। বোঝা যায়, রাস্তাটা তৈরি করেছে বেশিদিন হয়নি। হাওরের বুক চিরে বানানো এই নতুন পথের প্রায় জায়গায় রাতের কালো অন্ধকার। এরমধ্যে গাড়ির সামনের লাইট নাকি নষ্ট, ড্রাইভার জানাল। ভাবলাম ড্রাইভার ইচ্ছা করেই এমনটা করল কিনা। তাই অনেকটা অন্ধকারের মাঝেই অনিশ্চয়তা নিয়ে গাড়ি চলছে। কখন দুর্ঘটনা ঘটে এমন একটা অপেক্ষার ভাব আমাদের মাঝে। এরই মধ্যে এক মোটর সাইকেল ওয়ালা দেখি আমাদের সিএনজি ফলো করছে। আমি ধরেই নিয়েছি কোনো দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু অনেকক্ষণ পর জানতে পারলাম, সিএনজির লাইট নাই ভেবে হোন্ডা ড্রাইভার তার আলো দিয়ে আমাদের পথ চলতে সাহায্য করেছে। যাক এবারের মতো বাঁচা গেল। সিলেটে পৌঁছে গেলাম কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই।
রাতের খাবার গ্রহণ করে হোটেলে শুয়ে শুয়ে প্ল্যান হলো আগামীকাল সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওড় ও নীলাদ্রি দেখতে যাব। কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি-ঝড়। বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়ার ছন্দপতন হলো। আমাদের প্ল্যানেও পরিবর্তন আসবে আসবে ভাব। দুজন ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছি কিন্তু একজন হাওড়ের হাওয়া খেতে বদ্ধপরিকর। শেষপর্যন্ত সাখাওয়াত ভাইয়ের সাথে আমরা ২জন যোগ দিলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশে। এসি বাসে যাত্রা, রাস্তা বেশ ভালো কখন যে সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছে গেলাম টেরই পেলাম না। এখান থেকে যেতে হবে তাহিরপুর উপজেলায়। এই পথে সিএনজি ছাড়া কোনো যানবাহন নেই। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করলাম। যখন তাহেরপুর পৌঁছালাম, তখন মনে হলো হাওড়ে নামার আগেই গোসল করা শেষ। খানিকটা দূরেই নৌকাঘাট। এবারও বিছানাকান্দির স্টাইল লক্ষ করলাম। এখানে ৬/৮ হাজার টাকা ডিমান্ড করল ঘুরতে। ৩ জনে এত টাকা দিয়ে ঘুরব কীভাবে, এসব চিন্তা করতে করতে শেষ পর্যন্ত ১২০০ টাকায় নৌকার হিসাব মিটমাট করলাম। শুরু হলো, বহুকাক্সিক্ষত টাঙ্গুয়ার হাওড় ভ্রমণ। নৌকা চলছে আর তার সাথে ছবি তোলাও চলছে। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ওয়াচটাওয়ার পৌঁছালাম। সারা হাওড়ে নৌকা আর ট্রলার। হাজার হাজার মানুষ ভ্রমণে এসেছে যাদের অনেকেই রাতে এই হাওড়ে রাত্রিযাপন করবে। এটাই নাকি হাওড়ের আনন্দ। তাজা মাছ আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করবে সবাই। কিন্তু আমরা ফিরে যাব, তাই কিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করে নীলাদ্রির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। এখানে যারা আসে সবাই হাওড়ে গোসল করে, কিন্তু আমরা আর গোসল করলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলাদ্রি পৌঁছে যাই। এখানে উঠে দেখি বিশাল এক জগৎ, এই জগৎ শেষ করতে হলে সারাদিন লেগে যাবে। তাই কালবিলম্ব না করে হোন্ডায় ঘুরতে বের হলাম। নীলাদ্রি, সাদা পাথর, বারিক্কা টিলা আর জাদুকাটা নদী দেখে নৌকায় ফিরলাম। পাশেই শিমুল বাগান, নদী পার হতে হবে ভেবে আর যাওয়া হলো না। এবার নৌকায় তাহেরপুর ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখানে এসেও আবার জিম্মি হলাম সিএনজি ড্রাইভারের কাছে। ৫ জনের সিটের ভাড়া দিয়ে শেষ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছালাম ৩জন। রাতের গাড়িতে ঢাকা ফিরতে হবে। হানিফ বাসে রাত ১১টার টিকিট কেটে ঢাকা ফিরছি।
গাড়ি ছাড়ার আগে হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে, তাই রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাওয়ার পালা। বাসস্ট্যান্ডের রেস্টুরেন্ট তেমন ভালো হয় না সাধারণত। কিন্তু রেস্টুরেন্টের নাম দেখে মনে হলো এখানে ব্যতিক্রম হবে।
ব্র্যান্ডের একটি হোটেলে সফরের শেষ খাবার খাচ্ছি। যার যেমন ইচ্ছা তেমনটাই অর্ডার করা হলো। রেস্টুরেন্টটা ওপরে বেশ পরিপাটি হলেও খাবারের মান তেমন একটা ভালো না। খাবারের প্রচুর দাম। বিগত কয়েক দিনের সফরের ক্লান্তি আর বাড়ি ফেরার আনন্দে খাওয়া-দাওয়া হলো। এই সফরের সময় গপ লিডারের দায়িত্ব পালন করা সাখাওয়াত সাহেবকে তার ইচ্ছামতো খাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো। এই কয়দিন বেচারা ইচ্ছামতো খেতে পেরেছে কিনা সন্দেহ আছে!সোবহান ভাই সবসময় তার খাবারের পেছনে লেগেছিল বলে মনে হলো। তাই এবার শেষ ইচ্ছা পূরণের পালা। সাখাওয়াত সাহেব এবার কারও কোনো কথায় কর্ণপাত না করে শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। হোটেল বয়গুলো তার ইচ্ছায় বাধা দিলেন না। এক্সট্রা যখন যা লাগে সাপ্লাই দিলেন। তৃপ্তি সহকারে খাবার গ্রহণ শেষে মসজিদে গিয়ে এশার নামাজ আদায় করি। নামাজ আদায় শেষে কিছুটা সময় মসজিদে বিশ্রাম নিয়ে রাত ১১টার গাড়িতে উঠে গেলাম। ভ্রমণের ক্লান্তিও সবাইকে কমবেশি আক্রান্ত করেছে। তাই সুযোগ পেলেই ঘুমের চেষ্টা। বাস জার্নিতে আমার ঘুম হয় না, কিন্তু আমার দুই সহকর্মীর ঘুম ঠেকায় কে?বিশেষ করে সাখাওয়াত ভাইয়ের ঘুম। বাসে উঠতে দেরি কিন্তু ঘুমাতে তিনি সামান্য কালবিলম্ব করেন না কখনো। গত তিন-চার দিন যখন যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে দেননি কখনো। কি চলন্ত গাড়ি কি সিএনজি কোনোটাই বাদ যায়নি তার ঘুম থেকে। মাঝে মাঝে মনে হতো এই বুঝি ঘুমের কারণে কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হতে যাচ্ছেন তিনি। অবশ্য সারাটা পথে বেশ ঘুমিয়েছেন কিন্তু তেমন দুর্ঘটনার খবর নেই আপাতত বলা যায়, সচেতন ঘুমওয়ালা। এভাবে সাখাওয়াত ভাইয়ের ঘুম নিয়ে গবেষণা করতে করতে ঢাকায় পৌঁছে গেলাম খুব সকালে। শরীরটা ঢাকা পৌঁছেছে ঠিকই কিন্তু মনটা পড়ে আছে সিলেটের বিভিন্ন স্পটে। ঢাকার পথ-প্রান্তর সামনে এসেছে কিন্তু হৃদয়ে বারবার ভেসে উঠেছে সিলেটের রাতারগুল, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, সাদা পাথর, তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওড়, নীলাদ্রি আর জাদুকাটা নদীর দৃশ্য। আর কিছু না হয় মনে নাই করলাম। কবি জীবনানন্দ দাশ যথার্থই বলেছেন-
‘সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে
আবার আসিব আমি বাংলার নদী-মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।’
(লেখক : প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম খান, অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা।)