সুরুজের চিঠি- ড. নজরুল ইসলাম খান

জীবনের প্রথম চাকরি হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভাগীয়প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। আমার যোগ্যতা আছে কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে এই চেয়ারে বসতে আমি অনীহা প্রকাশ করি। ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আমাকে ডেকে বোঝালেন, তোমার সিনিয়র কেউ না-আসা পর্যন্ত তুমি এই দায়িত্বটা পালন করে যাও। আমার প্রতিদিনই মনে হয়, এই বুঝি নুতন কেউ এসে এই চেয়ারে বসলেন। কিন্তু না, চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত কেউ আর যোগদান করেননি আর আমাকেও চেয়ারটা ছাড়তে হয়নি। বিভাগীয়প্রধান হওয়ার সুবাদে আয়া, পিয়ন এবং অন্যান্য সাপোর্ট-সার্ভিস সহজে পেয়ে যাই। চাকরির শুরুতেই একটা বস বস ভাব চলে আসে, সবাই সালাম-কালাম দেয়া শুরু করে। অন্য বিভাগের বিভাগীয়প্রধানগণ আমার সিনিয়র, তাই তাদের সামনে কথা বলতে খুব লজ্জা পেতাম। কিন্তু আমার নামের শুরুতে ডক্টর থাকায় তারা আমাকে সিনিয়রের মর্যাদায় ভাবতেন। আমার চাকরিজীবনে বাসা থেকে কোনো দিন লা নিয়ে যাইনি, তাই দুপুরে খাওয়ার জন্য বাইরে যেতে হতো। ক্যাম্পাসে তেমন কোনো খাবার ব্যবস্থা ছিল না। একদিন আমার পিয়ন সুরুজ আমাকে জিজ্ঞাসা করে,
: স্যার, দুপুর হলে কোথায় যান আপনি?
: খেতে যাই সুরুজ। কেন সুরুজ, কেউ কি আমাকে খুঁজেছে?
: না স্যার, খুঁজেনি কেউ। বাইরে খেতে যেতে আপনার কষ্ট হয় না স্যার?
: তা তো কিছু হয়ই সুরুজ, অনেক ঝামেলা মনে হয়। কিন্তু কী করবো, খাবার তো খেতেই হবে, তাই না?
সুরুজ বলে, আমার কথা মানতে পারবেন স্যার?
: হ্যাঁ, কেন নয়। বলো, কী তোমার কথা?
: স্যার আমি আপনাকে প্রতিদিন খাবার এনে দেবো।
আমি সুরুজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে আরও কিছু বলতে চায়। আমি সুরুজকে বললাম, তুমি আরও কিছু বলতে চাও?
সুরুজ একটু সংকোচ নিয়ে বলল, স্যার যদি আমাকে একটু বাড়তি সুযোগ দেন।
: কী বাড়তি সুযোগ চাও তুমি? বলো না।
সুরুজ বলে, আজকে থাক স্যার, আরেকদিন বলবো।
আমিও ওখানেই থেমে যাই। সুরুজের সাথে আর কথা হয় না সেদিন।
সুরুজের কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। আমি একটু চিন্তায় পড়ে যাই। ছেলেটা তো বেশ নম্র-ভদ্র, বংশীয় ছেলে হবে হয়তো। খারাপ কোনো সুযোগ নিশ্চয় চাইবে না। সুরুজও আর আমাকে কিছু বলে না, আমিও সুরুজের কাছে জানতে চাই না, কী সুযোগ সে চায়। কী জানি সুরুজ আবার কী চেয়ে বসেÑআমি হয়তো ওকে দিতে পারবো না। এভাবে বেশ কিছুদিন চলে যায়, দুইজনের কেউ কারও কাছে কোনো প্রশ্ন করি না। আমি অন্য এক কলিগের সাথে হোটেলে খেতে যাই। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের। খাবার খেতে খেতে বেশ একটু আড্ডাও দেয়া হয়। এই সুযোগে পরস্পরের মধ্যে একটা সখ্যও গড়ে ওঠে, আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে যাই খুব কম সময়ে।
একদিন ক্যাম্পাসে যেতে দেরি হয়। বাইরে কিছু কাজটাজ সেরে যেতে যেতে দুপুর। রুমে গিয়ে দেখি, আমার টেবিলে খাবার রেডি। ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট খাবার পাঠিয়েছে হয়তো। সুরুজ বিভাগে নেই, নেই ক্যাম্পাসের আশেপাশেও। কাউকে দেখছি না, খাবার কোত্থেকে এল তার কোনো খোঁজও পাচ্ছি না। পেটে ক্ষুধাও আছে, কী করি ভেবে পাচ্ছি না। এরই মধ্যে আমার কলিগ এসে হাজির লাে যাওয়ার জন্য। টেবিলে খাবার দেখে তিনিও অবাক। দুইজনে মিলে খাবারটা খাওয়ার প্ল্যান করি কিন্তু খাবার নিরাপদ কিনা, তা নিয়ে দুজনে ভাবনায় পড়ে যাই। রুমে যারা আসে সবাই খাবার নিয়ে গবেষণা করে, কোত্থেকে এসেছে, কে পাঠিয়েছে। তখন মোবাইল ফোন এতটা সহজলভ্য হয়নি যে, পিয়নের কাছে ফোন থাকবে। তাই যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। খাবারের মেন্যু অনেক চমৎকার, আর বিলম্ব করা যাচ্ছে না। আমার পছন্দের গরুর ভুনা গোশত, সবজি আর ডাল চচ্চরি। খাবার খেতে খেতে বুঝতে পারছি এটা কোনো হোটেলের খাবার হবে, কেউ বাসা থেকে নিয়ে আসেনি। হোটেলের খাবার অফিসে বসে খাচ্ছি আর ভাবছি কার খাবার খাচ্ছি, কেন খাচ্ছি। যদি অন্য কারও খাবার হয়ে থাকে, ভেবে মনে মনে লজ্জা পাচ্ছি।
খাবার খাওয়া শেষ সুরুজ হাজির। মুচকি হাসি, স্যার কোথায় খেয়েছেন? কেমন লেগেছে, এসব খাবার আপনি পছন্দ করেন তো? আরও অনেক কথা সে গড়গড় করে বলে গেল। আমি নিরুত্তর। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি খাবারটা কি সুরুজ আমার জন্য রেখেছিল, না ও খাবে বলে এনেছে। আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি, আমার কলিগ তো লজ্জায় কিছু না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। এত মজার খাবার খেয়ে তন্দ্রা আসছে, সুরুজ দূর থেকে ভারি মজা পাচ্ছে। এরই মধ্যে রেজিস্ট্রার স্যারের ফরমায়েশ শুনতে তার অফিসে চলে যাই। এসে দেখি আবার সুরুজ লাপাত্তা। খাবারের রহস্য না জানা পর্যন্ত পেটের মধ্যে যেন ক্যামন ক্যামন লাগছে। অন্য সব পিয়নের কাছে সুরুজ সম্পর্কে জানতে চাই, কেউ ওর সম্পর্কে কিছু বলে না। রহস্য আরও বেড়ে যায়, অন্য ভাবনা ভর করে মাথায়।
পরের দিন টেবিলে এসে দেখি ৭ দিনের ছুটির দরখাস্ত। সুরুজ বাড়িতে চলে গেছে। ক্যাম্পাসের কেউ ওর বিস্তারিত তথ্য জানে না। সুরুজ আগে ইংরেজি বিভাগে চাকরি করত। আমি আসার পর নাকি তদবির করে আমার বিভাগে এসেছে। আমার জানা ছিল না এসব কথা। যত ওর সম্পর্কে জানছি ততই অবাক হচ্ছি এবং মনে একটা সন্দেহ ক্রমশ দান বেঁধে উঠছে। বিভাগের অন্যসব কাজ-কর্ম রেখে সুরুজ-গবেষণায় নেমে পড়ি, এমনি এক অবস্থা আমার। ও নাকি অনেক লেখাপড়া জানে। দু-চারটা ইংরেজিও পারে। আমার বক্তব্য শোনার পর অফিসিয়ালি সুরুজের বায়োডাটার খোঁজ করা হয়। ভিসি স্যার খুঁজেখুঁজে ওর এলাকার একটা লোক বের করে, যোগাযোগ করে। কিন্তু জানা গেল, সুরুজ বাড়িতে যায়নি। বিস্তারিত কেউ নাকি জানাতে রাজি হচ্ছিল না। ঘটনা শোনার পর বিভাগে যেতে রীতিমত ভয় পেতে লাগলাম। সকালে গিয়ে ক্লাস নেয়ার পর অন্য বিভাগে গিয়ে বসে থাকি। কী জানি ও কোত্থেকে কাকে নিয়ে আসে, কেমন যেন একটা আতঙ্ক বিরাজ করতে শুরু করছে।
প্রতিদিন নতুন নতুন লোক ওর খোঁজ নিতে আসে। লোকজন দেখে মনে করার কোনো উপায় নেই সুরুজ খারাপ ছেলে হবে। সবাই চিন্তিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে জানানোর প্রয়োজন মনে করি, প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুঁজে দেখি, কোনো দুর্ঘটনা হলো না তো!
রেজিস্ট্রার স্যার একজন সাবেক আমলা তাই এবার তার শরণাপন্ন হই। তিনি শুনেই খারাপ একটা মন্তব্য করেনÑযা শুনে আমি চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি নিই। সাত দিন ছুটির আবেদন করি, প্রশাসনে হাসি-ঠাট্টার রোল পড়ে যায়। জুনিয়র মেয়েগুলো এডমিশন অফিসে চাকরি করে, ওদের কথায় লজ্জায় পড়ে যাই। কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, সুরুজ কেন এমন আচরণ করল। ওর সাথে সামান্য কয়দিনের পরিচয়, কেনই-বা আমার সাথে এমন আচরণ করল। আরও সাত দিন চলে যায় কিন্তু সুরুজের আসার কোনো খবর নেই। আমাকে নতুন পিয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু আমি নিতে চাচ্ছি না। কারণ এত কিছুর পরেও সুরুজকেই আমার পছন্দ, মনে মনে তাকে চাই।
একটা সময় বাসায় জানাজানি হয়ে যায় বিষয়টি। সুরুজ কি আমার পূর্ব-পরিচিতি কেউ, নাকি আমার কোনো দূর আত্মীয়-স্বজন। আমি হয়েতো তাকে চিনি না কিন্তু সে ঠিকই আমাকে চেনে। লজ্জায় কি আমার থেকে পালিয়ে গেল নাকি খারাপ কোনো উদ্দেশ্য আছে সুরুজের। এসবই ভাবছিলাম। হঠাৎ একদিন আমার মোবাইলে সুরুজ ফোন দিয়ে আমার কুশল জানতে চায় কিন্তু ওর কুশল জানায় না, প্রশ্ন করতেই লাইনটা কেটে যায়। আমি তখনই ওই নম্বরে ফোন করে দেখি নাম্বারটা বন্ধ। ওর কণ্ঠ শুনে মনে হয়নি ও কোনো কষ্টে আছে অথবা খারাপ কোনো পরিস্থিতিতে আছে। আবার চিন্তায় পড়ে যাই ওকে নিয়ে। সারাদিন ঐ নাম্বারে ফোন দেয়ার চেষ্টা করি কিন্তু মোবাইল সব সময় বন্ধ আছে।
ঘটনার অনেক দিন পর আমার নামে একটা মানি অর্ডার আসে নোয়াখালী থেকে। প্রেরকের জায়গায় সুরুজের নাম লেখা। ঠিকানায় কিছু ভুল আছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঠিকানা নির্ভুল থাকায় মানি অর্ডার পৌঁছে যায়। চিঠির ঠিকানা ওর নিজের হাতের লেখা। পিয়ন হলেও লেখা দেখে বোঝার উপায় নেই এটা ওর লেখা। কেন সুরুজ আমার নামে টাকা পাঠাবে? এর কোনো উত্তর আমি খুঁজে পাই না। ডাক পিয়নের দেয়া টাকাটা একটা খামে করে আলমিরায় তুলে রাখি। হয়তো ঠিকানা ভুল হয়েছে অথবা ওর নিজের প্রয়োজনে টাকাটা আমার ঠিকানায় পাঠিয়েছে। উদ্বিগ্নতা আরও বাড়তে থাকে।
মানি অর্ডারের খবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জেনে যায়। একটু পর পর অন্য বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা টাকা প্রাপ্তির সত্যাসত্য খবর নিতে আসে। আমি খাম খুলে খুলে সবাইকে টাকাটা দেখাই। টাকা খরচ করার কোনো আবেগ বা ইচ্ছা আমার মধ্যে কাজ করছে না। যদিও সবাই আমাকে টাকাটা খরচ করতে বলে, তবুও আমি আমানত মনে করে টাকাটায় হাত দিইনি। মাঝেমধ্যে টাকার প্রয়োজন দেখা দিলেও এই টাকা খরচ করার মানসিকতা আমার তৈরি হয়নি। কেউ কেউ টাকাটা দান-সদকা করে দিতে বলছেন, আবার কেউ বলেছেন মসজিদ-মাদ্রাসায় দিয়ে দিতে। কিন্তু আমার ইচ্ছা টাকাটা যে পাঠিয়েছে তার হাতে তুলে দেয়ার। কবে আসবে টাকার প্রেরক আর কবে শেষ হবে আমার আমানতদারিতাÑএমনি ভাবনায় দিন-মাস চলে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় রমজানের ঈদসহ বেশ একটা লম্বা ছুটি হয়। অনেক দিন ক্লাস, পরীক্ষা সব বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া হয় না। কিন্তু বারবার একটা কথা মনে পড়ছে, অন্য কোনো চিঠি আসেনি তো? মাঝেমধ্যে অফিসে ফোন করে খবর নিচ্ছি। শাম্মি নামে একটা মেয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে চাকরি করতো। ও বলেছে স্যার আপনার চিঠি আসেনি তবে ডাকপিয়ন একদিন আপনাকে খুঁজেছে। এ কথা শোনামাত্রই আমার মন বলছে নিশ্চয় সুরুজের কোনো চিঠি আছে। ছুটি এখনও কয়েকদিন বাকি আছে কিন্তু আমার মন আর বসছে না কোনো কাজে। ভাবছি আর অপেক্ষায় আছি কবে বিশ^বিদ্যালয়ের ছুটি শেষ হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শেষ হলো। আমি মনে একরকম দুশ্চিন্তা নিয়েই অফিসে যাই। গিয়ে দেখি একটি রঙিন খামে ছোটো একটা চিঠি আমার রুমের মধ্যে। শুরুতে এমন খাম দেখে বিয়ের দাওয়াতপত্র ভেবেছি। তাই খোলার খুব আকর্ষণ ছিল না আমার মধ্যে। কারণ প্রতি সপ্তাহে এত দাওয়াত খাওয়া কী করে সম্ভব। যে টাকা মাইনে পাই তাতে দাওয়াত খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রথম দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে করতে চিঠি খোলার কথা ভুলে যাই। বাসায় ফিরে চিঠির কথা মনে করতেই আমার অস্থিরতা বেড়ে যায়। মনস্থির করি কাল সকালে গিয়ে আগে চিঠির রহস্যটা উদঘাটন করব।
পরের দিন খুব সকালে বাসা থেকে বের হই কিন্তু ঘটনাচক্রে সেদিন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয় না। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে অর্ধেক পথ গিয়েই বাসায় ফিরতে হয়। বিষয়টা আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি এককেন্দ্রিক করে ফেলেছে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। পরের দিন যথাসময়ে বিশ^বিদ্যালয়ে পৌঁছে চিঠিটা খুলে একনজর দেখে নিশ্চিত হই যে সুরুজ ভালো আছে, চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর আয়েস করে বসে চিঠিটা পড়লাম।
সুরুজ লিখেছে-
স্যার, মনে কিছু করবেন না। এই সামান্য কয়টা টাকা আপনার জন্য পাঠালাম। সময় সুযোগ মতো আরও কিছু টাকা পাঠাবো। হয়তো প্রশ্ন করবেন কেন আমি টাকা পাঠালাম? স্যার, আমার মনে আছে আপনি প্রতিদিন হোটেলে গিয়ে লা করতেন আর আমি ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে নোট, বই-পত্র, এসাইনমেন্ট বিক্রি করে কিছু টাকা ইনকাম করতাম। তারা আমার থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য বাড়তি কিছু টাকাও আমাকে দিতো। যা স্যার আপনি জানেন না। কিন্তু আমি দেখলাম দিনে দিনে অবৈধ টাকায় আমার খুব ক্ষতি হচ্ছে, আমার সংসার ভেঙে তছনছ হচ্ছে। প্রতিদিন আমার ফ্যামিলির কেউ না কেউ হাসপাতালের রোগী হচ্ছে। সংসারের লোকজনের এমন সব রোগ-ব্যাধি হচ্ছে যার চিকিৎসার খরচ যোগানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি আপনার পিয়ন অথচ আপনি কেনো টাকা নিচ্ছেন না সব টাকা আমাকে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে দেখি দুপুরের লা করার টাকা পর্যন্ত আপনার পকেটে থাকে না। বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত আমি ভাবছি। কী করা যায় ভেবে কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে হারাম ইনকামের পথ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি জানি স্যার, আপনাকে বলে আমি আসতে পারবো না। এ ছাড়া আপনার প্রতি আমার একটা মায়া কাজ করবে। যেখানে অনেকভাবে ইনকামের সুযোগ আপনার সামনে আছে অথচ আপনি কষ্ট করে চলেন। আপনার বিষয়টা আমাকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। আমি নিজেকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিই, কারণটা শুধুই আপনি স্যার। আপনাকে দেখেই মনে হতো আপনি যদি সৎ থাকতে পারেন তাহলে আমি কেন সৎ পথে চলতে পারবো না। আপনার সংসারে তো কোনো ঝামেলা আমি কোনো দিন শুনিনি অথচ আমার সংসারে প্রতিদিন কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই আছে। রাতে আমার ঘুম হয় না স্যার। দিনের বেলায় আমি ভালো করে ডিউটি করতে পারি না। আপনাকে প্রতিদিন এটা ওটা বলে অজুহাত দিই। এভাবে মিথ্যা বলে আর চাকরি করতে ভালো লাগে না স্যার।
স্যার, কিছু মনে নিবেন না। যে টাকাগুলো পাঠিয়েছি এর মধ্যে অধিকাংশ টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের আর কিছু টাকা আপনার। অনেক সময় মিথ্যা বলে আপনার থেকে টাকা নিয়েছি স্যার। সরল মনে আপনি আমাকে টাকা দিয়েছেন, আমি জানি এই টাকা আপনার কষ্টের টাকা। স্যার, টাকাগুলো গ্রহণ করবেন আর বাকি টাকা সবাইকে দিয়ে দিবেন। কেউ বেশি টাকা দাবি করলে লিখে রাখবেন, আমি আবারও টাকা পাঠাবো। যেদিন থেকে হারাম ইনকামের নিয়ত ছেড়েছি সেদিনই একটা ভালো চাকরি পেয়ে যাই স্যার। বেতন ভালো পাই, হারাম ইনকামের কোনো সুযোগ নাই, ইচ্ছাও নাই স্যার। কোনোরকমে জীবনটা বাঁচাতে পারলে খুশি এখন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেছি, আর মিথ্যা বলাও বন্ধ করেছি। কয়েক দিন যাবত ঘুমেরও কোনো অসুবিধা নেই স্যার। আমি সবাইকে বলে আসতে পারিনি তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই স্যার, কিন্তু এখন আপনার জন্য খারাপ লাগছে। স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, জীবনে মানুষ হতে পারলে আপনার সাথে দেখা করবো আবার।
ইতি-
সুরুজ।

সুরুজের চিঠি পড়ার পর থমকে দাঁড়াই, ওর বিবেক বুদ্ধির কাছে আমি হেরে যাই। সমাজের অন্য মানুষের সাথে ওর চিন্তার মিল খুঁজে বেড়াই। সবাই টাকা কামানোর সোজা রাস্তা খোঁজে, আর সুরুজ খুঁজছে কঠিন পথ। পাপাচারে যে শান্তি মেলে না তা সুরুজ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। সময় থাকতে নিজে বেঁচেছে, তার পরিবার-পরিজনকেও বাঁচিয়েছে। আমাদের সমাজ-সংসারে এমন সুরুজের আজ বড্ড অভাব। কিন্তু আমরা ভুলে যাই নিজের ইজ্জত-সম্মানের কথা। অর্থের জন্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা আমরা করি না। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা অর্থ উপার্জন করতে চাইÑযা আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাদা চোখে আমরা এসব ধ্বংস দেখতে পাই না কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে আমরা বুঝতে পারি এসব মোহ-ই আমাদের ধ্বংসের মূল কারণ।

(ড. নজরুল ইসলাম খান, অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *