মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে ইবতেদায়ি সমাপনী শিক্ষা পরীক্ষায়। এবার প্রাথমিক সমাপনী শিক্ষা পরীক্ষায় মোট ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ২৬৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। যা গেল বছরের চেয়ে ২ লাখ ২৩ হাজার ৬১৫ জন কমেছে। অন্যদিকে ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এবার অংশ নিচ্ছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৭১ জন শিক্ষার্থী। যা গেল বছরের চেয়ে ৩০ হাজার ৯৮৩ জন বেশি।
সাধারণ মাধ্যমের চেয়ে মাদ্রাসা মাধ্যমে এবার পরীক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী? প্রশ্ন ছিলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কাছে। জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বললেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় দেশে জনসংখ্যা কমছে, তাই তার প্রভাব এই শিক্ষা মাধ্যমে পড়েছে।’
প্রতিমন্ত্রীর উত্তরটি এতোই অযৌক্তিক যে; তা আলোচনার টেবিলে ন্যুনতম গুরুত্বের দাবী রাখে না।
বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে যেখানে অতীতে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত ছিলো; সেদেশগুলোতে মাদ্রাসার সংখ্যা কমছে। জোর দেয়া হয়েছে সাধারণ শিক্ষার ওপর। ব্যতিক্রম বাদ দিলে মাদ্রাসা শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের রাষ্ট্রের মূল অর্থনৈতিক ধারার কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকার বঞ্চিত শিশু হিসেবে মাদ্রাসায় ভর্তি করার পর শিশুটি যে শিক্ষা লাভ করছে; কর্মক্ষেত্রে তার প্রায়োগিক প্রাসঙ্গিকতা না থাকায়; অধিকার বঞ্চিত হিসেবেই বাকি জীবন যাপন করছে সে।
অপরিবর্তনীয় বঞ্চনার শৃংখলে আটকে যাওয়ায় তরুণ ও যুবা বয়েসে সে শ্রেণী সংগ্রামের কথা ভাবছে। উদ্দেশ্যহীন সহিংসতায় অনেকে মারা পড়ছে। যারা বেঁচে থাকছে; তাদেরও ভাগ্য পরিবর্তনের কোন দিশা থাকে না। সম্প্রতি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ইসলামী কট্টরপন্থী নেতা মওলানা ফজলুর রহমান আয়োজিত কথিত আজাদি মার্চে ফজলুর রহমানের মালিকানায় থাকায় মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ‘জলসা’ সফল করার জন্য বসে থাকতে দেখা গেছে। আপনি লংমার্চে কেন, এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চান? এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই তাদের জীবন বাস্তবতা তুলে ধরেছে; যেখানে কর্মসংস্থানের কোন রকম সম্ভাবনাহীনতা আর জীবনের উদ্দেশ্যহীনতার বেদনাদায়ক ছবি উঠে এসেছে।
মানুষকে ভালবাসার চোখে দেখতে হয়; মানুষ তো কেবলই রাজনৈতিক ও ক্ষমতার লড়াইয়ের ফুটসোলজার হতে পারে না। কাজেই মাদ্রাসার ছাত্রদের স্বপ্নহীনতার বাস্তবতা হৃদয় বিদীর্ণ করে। ধর্ম খুব ভালোবাসার একটি ব্যক্তিগত আশ্রয়। ধর্ম শিক্ষা ও কুরান পাঠ শিশুদের নৈতিকতা বর্ধনে সহায়ক হয়। কিন্তু আত্মার পরিচর্যার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থায় ধর্ম-নৈতিকতা-দর্শন পাঠের মাধ্যমে আত্মার পরিচর্যার সুযোগ রয়েছে। বরং সাধারণ শিক্ষাতে আরো কর্মসংস্থানমুখী প্রশিক্ষণ যুক্ত করে সামষ্টিকভাবে শিশুদের আগামির কর্মী-অর্থনীতির সহিস-প্রগতির সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলাই সময়ের দাবি।
যে আরব বিশ্বে ইসলাম ধর্ম চর্চার গভীরতা ও প্রাবল্যের ইতিহাস প্রাচীন; সেইখানে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে; যাতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈশ্বিক ধারার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।
সেইখানে বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে নানা রাজনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ কেন হতে হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ঠোঁটে জামায়াতকে একটি রাক্ষসের জুজু হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা; আর আওয়ামী লীগ সরকারের মাদ্রাসা-তোষণ রাজনীতির হেফাজতিতে ‘অধিকার বঞ্চিত’ শিশুদের কর্মমুখর আগামির চিন্তাটি উপেক্ষিত।
ভারতে এখন হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী রাজনীতির জোয়ার; সে অভিঘাতে খুব স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদের ভোক্তা রয়েছে। দিনমান ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নানা অপকথার ডালি নিয়ে হাজির হয় শিবসেনারা; মুখে তাদের শিবির নিধনের শোরগোল। এই বাস্তবতায় ‘ইসলাম ধর্ম’-কে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা বাংলাদেশের সাধারণ্যে দৃশ্যমান।
আওয়ামী শিবিরের শ’চারেক ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র লিপসার্ভিস দেয়া বুদ্ধিজীবী রয়েছে। এরা এমন কট্টর প্রগতির গাল-গল্প দেয় যে, বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানেরা তাদের ধর্মীয় আত্মপরিচয় খোয়া যাবার প্যারানয়ায় আক্রান্ত হয়।
এইসব কথিত বুদ্ধিজীবীরাই “অসাম্প্রদায়িক আদর্শের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন কট্টর সাম্প্রদায়িক মোদি” এরকম আইরনিক্যাল সিদ্ধান্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত হবার যোগ্যতা না থাকায়; ভারতে নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে আঞ্চলিকতার মাঝে আন্তর্জাতিকতার সুখ খুঁজতে এরা ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে; বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভীত করে তোলে।
বিএনপি শিবিরের শ’খানেক ইসলামি আত্মপরিচয়ের লিপ সার্ভিস দেয়া বুদ্ধিজীবী, জনগণের এই ‘ভারত জুজু’র লক্ষণ দেখে সেটাকে রাজনীতির পুঁজি করে সারাক্ষণ এই ‘ভারত-প্রীতির’ ভীতি ছড়িয়ে দেয়।
ভূ-রাজনীতি অনেক জটিল বিষয়; এখানে সব সময় বাইরে থেকে যা দেখা যায়; ভেতরে তা থাকে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্বল্পদ্রষ্টী বুদ্ধিজীবীরা জনগণের মাঝে, ‘ইসলাম গেলো গেলো’ গুজবের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
বাংলাদেশের ইসলাম মানবতাবাদী বাউল ও সুফিদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম। এই নদীর দেশে-সবুজ সমতলে; অশিক্ষার কারণে কুসংস্কারাচ্ছন্নতা আছে; কিন্তু ধর্মীয় কট্টরপন্থার শেকড় নেই। পাকিস্তান বা আফঘানিস্তানের মতো মরু কিংবা পাথর প্রবণ কর্কশ জনপদ নয় বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশে আল-কায়েদা বা আই এস প্যাটার্নের জঙ্গিবাদ বিকাশের কোন সুযোগ নেই। এখানে সহিংসতা ততটুকুই সম্ভব; যা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীরা করে দেখিয়েছে। এ হচ্ছে ঐতিহ্যসঞ্জাত ঠগীদের সন্ত্রাস আর লুন্ঠনের ভূমি।
কাজেই আলাদা করে ‘জামায়াত জুজু’ বা ‘বিজেপি জুজু’ দিয়ে লীগ ও বিএনপি দুটি বিবাদমান পক্ষ যতই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুক; জনগণের তাতে বিভ্রান্ত হওয়া অনুচিত। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসা বাংলা-ইংরেজি-গণিত-বিজ্ঞান এসব বিষয়ের ওপর জোর দিলে, কারিকুলামে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ যুক্ত করলে; ছাত্ররা উপকৃত হবে। আবার সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম-নৈতিকতা শিক্ষা, পবিত্র কোরান পাঠের মতো বিষয় থাকলে ছাত্রদের ধর্ম-নৈতিকতার দিকটি বিকশিত হবে।
মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক
(অন্য মাধ্যমে প্রকাশিত)