নারীবাদ: বোঝা ও বোঝাপড়া (পর্ব: ১)

শারমিন শামস্।।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, নারীবাদের সংজ্ঞাটাকে যতবার ও যতভাবে ভুল বোঝা হয়েছে, এ দুনিয়ায় আর কোন তত্ত্ব এত বেশি ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে পড়ে নাই। অথচ, নারীবাদ জটিল নয়। নারীবাদের অত্যন্ত সরল সোজা একটা সংজ্ঞা আছে। বলা যায়, নারীবাদের ভেতর যে সরলতা ও পরিচ্ছন্নতা আছে, তা অনেক বিশ্বজয়ী জনপ্রিয় তত্ত্বের নাই। তবু নারীবাদ সমালোচিত, নানাভাবে নিন্দিত, অপমানিত ও বাধাগ্রস্থ।

এত কিছুর পরও নারীবাদ তবু স্থবির না। মানে নারীবাদের গতি আছে, নারীবাদ ক্রমশ নিজেকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং নানাভাবে উৎকর্ষ লাভ করে। নারীবাদ চলমান, আপডেটেড এবং যুগের সাথে সারাক্ষণ নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে।

নারীবাদ বা ফেমিনিজমের মূল সংজ্ঞায় যাবার আগে বলতে চাই, প্রকৃত অর্থে নারীবাদ হল একটা অনুভব, যা আপনি আপনার ভেতরে অনুধাবন করবেন। টের পাবেন। নারীবাদ একটা শক্তির নাম এবং অবশ্যই সততার নাম। এটা এমন এক শক্তি যা আপনার ভেতরে তৈরি করবে দুর্মর রাগ আর ক্ষোভ, যে রাগকে গঠনমূলক চিন্তা আর চেতনায় রূপ দিতে চাইবেন আপনি। যদি আপনি নারী হন , নারীবাদ হল তাই, যখন আপনি টের পাবেন যে আপনাকে ক্রমাগত প্রতারণা করা হয়েছে। নারীবাদ আপনাকে অনুভব করতে শেখাবে, আপনার যা পাওয়ার ছিল, আপনি তা পাননি। আপনি ঠকেছেন। আপনি কোনঠাসা ও ভীত হয়ে আছেন এবং আপনি নিরাপদ নন। যখন আপনি বুঝতে পারবেন আপনার চারপাশে একটা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য- দুই ধরণের সীমানারেখাই টেনে দেয়া আছে।

আর আপনি যদি পুরুষ হন, বুঝতে পারবেন, শুধুমাত্র শারীরিক পার্থক্যের জন্য আপনার বিপরীত লিঙ্গের চেয়ে আপনি বেশি ‍সুবিধা পাচ্ছেন। আপনি বড় হয়েছেন সীমারেখাহীন স্বাধীনতায়, যা আপনার পাশের মানুষটি পাননি, কেননা তিনি নারী। আপনি টের পাচ্ছেন, আপনার জীবন সেই নারীটির চেয়ে বহুগুনে সহজ ও নিরাপদ এবং আপনি তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাভোগী।

এই সব অনুভব, উপলব্ধি যখন আপনাকে অস্থির করে তুলছে, আপনাকে ভাবাচ্ছে, আপনি যখন এই অসমতা মেনে নিতে কষ্ট পাচ্ছেন, নারীবাদ আসলে তখনই আপনার ভেতরে বীজ হয়ে ঢুকে পড়েছে।

নারীবাদ কী?

নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার ও সুযোগ দেবার নামই নারীবাদ। নারীবাদ বলে, লিঙ্গ কখনো মানুষে মানুষে ব্যবধানের কারণ হতে পারে না। শারিরীকভাবে মানুষ যে লিঙ্গেরই হোন না কেন, সেটি তার অধিকারের প্রশ্নে কোন বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। নারী পুরুষের ভেতর লিঙ্গগত পার্থক্য রয়েছে- এটি জৈবিক। নারীবাদ বলছে, জৈবিক ভিন্নতা দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। একটি লিঙ্গকে বেশি যোগ্য বা বেশি উচ্চমানের ভাবার কোন সুযোগ নাই। লিঙ্গ যোগ্যতা নির্ধারণ করে না। একইভাবে, লিঙ্গের কারণে কেউ বেশি সুবিধা পাবে, কেউ বেশি অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চা করতে পারবে, অন্য পক্ষ তা পারবে না, তা হবে না। নারীবাদ মনে করে, নারী ও পুরুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমান অধিকার পাবে। কারণ মর্যাদায় পুরুষ নারীর উপরে বা বড় নয়। একইভাবে নারীও পুরুষের চেয়ে বড় বা উপরে নয়। নারীবাদ মানে নারী ও পুরুষ সব অর্থে সমান এবং দু’পক্ষই সমান অধিকার ভোগ করবে।

নারীবাদ পরিবর্তন চায় সমাজের। হাজার বছর ধরে যে সমাজ নির্মিত হয়েছে নারীকে পুরুষের অধীন হিসেবে বিবেচনা করে, নারীবাদ সেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে।

নারীবাদ একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে সমতা, সমঅধিকারে কথা বলছে। আর কিছু নয়। এর চেয়ে বেশি মানবতার কথা আর কোথায় পাবেন? অথচ, আজকাল নারীবাদ শুনে কেউ কেউ বলে ওঠেন, ‘নারীবাদ নয়, মানবতাবাদ চাই।’ এটা একটা ভুল ও মুর্খ বয়ান। কারণ নারীবাদই মানবতাবাদ। আপনি যত নারীবাদকে বুঝবেন, তত অনুভব করবেন যে একটি নিখাঁদ সুন্দর মানবতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠাই নারীবাদের একমাত্র ও মূল লক্ষ্য।

নারীবাদ একটা সংগ্রামের নাম। নারীবাদ একটা অ্যাকশন, নারীবাদ কাজ করে বদলের জন্য। না খুব বেশিদিন হয়নি, নারীবাদ বা ফেমিনিজম আলোর মুখ দেখেছে। ১৮৯০ এর দিকে ফেমিনিজম বা নারীবাদ শব্দটা আসলে উচ্চারিত হতে শুরু করল। কিন্তু তারো অনেক আগে থেকেই নারী কিন্তু তার বঞ্চনা আর অধিকারহীনতার কথা বলে আসছে। এই ধরুন ১৭০০’র গোড়ার দিক থেকেই পশ্চিমের নারীরা প্রশ্ন তুলছে- এই যে নারী আর পুরুষের মাঝে যোজন যোজন ব্যবধান, পাওয়া না পাওয়ার এই যে চরম অসামঞ্জস্য, এটি কি প্রাকৃতিক? নাকি চাপিয়ে দেয়া? এই বৈষম্য কি অপরিবর্তনীয়? এর কি কোন শেষ নেই?

এই প্রশ্নগুলোই করতে শুরু করেছিলেন পশ্চিমের কিছু নারী প্রায় তিনশ বছর আগে, তাদের লেখায়, আলোচনায় ও নানান বক্তব্যে। তারা প্রশ্ন তুলছিলেন এবং একই সাথে অবসান চাইছিলেন এই বিভেদ ও বৈষম্যের। হাজার বছর ধরে পুরুষের অধীনে নারী- এই অবস্থাটির পরিবর্তন চাইলেন তারা। একজন মানুষ হিসেবে পুরুষ যা কিছু অধিকার ভোগ করে, সেই একই অধিকার নারীর সমপরিমান প্রাপ্য- এসব কথা বলা শুরু হল। ফেমিনিজমের যাত্রা তখন থেকেই শুরু। নারীবাদ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলো। অবসান চাইলো পুরুষতন্ত্রের।

পুরুষের পৃথিবী

যে ধারণা বা অবস্থান মনে করে পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রাখে, সেটিই পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র মনে করে পুরুষের মূল্য নারীর চেয়ে বেশি, তাই পুরুষ নারীর চেয়ে যোগ্য ও ক্ষমতাবান এবং সব ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক পুরুষ। পুরুষতন্ত্র নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে না। কারণ পুরুষতন্ত্রের চোখে পুরুষ উন্নত এবং নারী নিচু শ্রেণির। পুরুষতন্ত্রের মতে, নারী পুরুষের চেয়ে সব অর্থেই কম, নিম্নস্তরের; এমনকি মানুষ হিসেবেও নারী পূর্ণ মানুষ নয়।

অনেক নারীবাদী ইতিহাসবিদ মনে করেন, যে সময়ের থেকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস আমরা পেতে শুরু করেছি, তারও আগের সময়ে কিছু সমাজের কাঠামো আলাদা ছিল। পঁচিশ হাজার বছরের পুরোনো প্রস্তর মূর্তি দেখে ধারণা করা যায়, মানুষ তখন দেবী বা নারীকেই আরাধনা করত। সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, মানেই নারীই প্রধান বা নারীই মূল চালক।

অস্ট্রিয়ান আমেরিকান নারীবাদী ইতিহাসবিদ Gerda Lerner এর তত্ত্বমতে, Patriarchy বা পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব কয়েক হাজার বছর আগে, যখন প্রথম নগর পত্তন হল, তখনই। পুরুষ বংশবৃদ্ধির বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল, যাতে সে নিজের ঔরষজাত সন্তানের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে এবং এভাবেই ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ অন্যান্য বিষয়াদি পুরুষের দিকে চলে গেল। প্রতিষ্ঠিত হল পুরুষের সাম্রাজ্য।

পুরুষতন্ত্র একটা চিন্তাগত অবস্থান ও ব্যবহার। পিতৃতন্ত্র একটা সিস্টেম বা একটি ক্ষমতার নাম। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘পিতার হুকুম’ বইটিতে পুরুষতন্ত্র আর পিতৃতন্ত্রের ভেতর যে মৌলিক পার্থক্য আছে, সেটির একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলছেন,

“এই পিতৃতান্ত্রিকতার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিকতার মিল আছে বলে মনে হবে, কিন্তু দুটি মোটেই এক বিষয় নয়, মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পিতার ভাবমূর্তি একজন পুরুষেরই, এবং পুরুষতান্ত্রিকতা হচ্ছে পুরুষের কর্তৃত্ব নারীর ওপরে; কিন্তু পিতৃতান্ত্রিকতা যে কেবল নারীর জন্য কর্তা, তা নয়। কর্তা সে পুরুষের ক্ষেত্রেও। পুরুষ ও নারী উভয়েই পিতৃতান্ত্রিকতার অধীনে থাকে, বাধ্য হয় থাকতে। তবে হ্যাঁ, নারী ও পুরুষের ভেতর একটা পার্থক্য করা হয়। সেটা ওই পিততৃতান্ত্রিকতাই করে দেয় এবং সে জন্য পিতৃতান্ত্রিকতার দুর্ভোগটা পুরুষের তুলনায় নারীকেই পোহাতে হয় অধিক মাত্রায়।’’ (পৃ:৬৯)

তিনি আরো লিখছেন, “পিতৃতান্ত্রিকতা ও পুরুষতান্ত্রিকতা যে এক নয়, এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে পিতাকে একজন পুরুষ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। এবং তিনি তথাকথিত পুরুষালি আচরণই করেন। অর্থাৎ কিনা মেয়েদের দেখেন ভিন্ন দৃষ্টিতে, তাদের বিবেচনা করেন পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র, কেবল স্বতন্ত্র নয়, দুর্বল হিসেবেই। মেয়েরা যে পিতার মত আচরণ করতে পারে না, তা-ও নয়। পারে। এবং করেও। মেয়ে যদি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, কিংবা প্রধানমন্ত্রী অথবা অফিসের প্রধান হন, তাহলে দেখা যাবে তিনিও কেবল পিতার মতো নন, পুরুষের মতোই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। যাতে প্রমাণিত হয় যে পিতৃতন্ত্র হচ্ছে একটা ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা নারী-পুরুষে পার্থক্য করে তো বটেই, তবে নারীকে দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পছন্দ করে।” (পৃ:৭১)

পিতৃতন্ত্রে পুরুষও শোষিত হন- এ কথা আমেরিকান নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট বেল হুকসের। বেল হুকস মনে করেন, পিতৃতন্ত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি শোষিত হয়। বেল হুকস বলেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীও তার চিন্তা ও কাজে পিতৃতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। তাই নারীবাদ মানে এভাবে ভাবা উচিত না যে এটা সমস্ত পুরুষের বিরুদ্ধে সমস্ত নারীর অবস্থান।

পুরুষতন্ত্র পুরুষকে মহান বলে বিশ্বাস করে, পুরুষকে শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বঞ্চনার বিপরীতে পুরুষ শুধু লাভবানই হয়।

ব্রিটিশ নারীবাদী Sylvia Walby ছয়টা মূল কাঠামোর কথা বলছেন যা পিতৃতন্ত্রকে সমর্থন দেয়, শক্তি যোগায়। এগুলি হল- গৃহস্থালীর কাজ, মজুরির বিনিময়ে শ্রম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস এবং যৌনতার প্রতি আচরণ। (Theorizing Patriarchy, Sylvia Walby, 1990)

আমরা যদি সিলভিয়ার দেয়া কাঠামোগুলো বিশ্লেষণ করি, দেখবো, আমাদের সমাজে বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন ধরুন, ঘরের কাজের দায় এখনও এদেশে নারীর ওপরই বর্তায়। পুরুষের অংশগ্রহণ খুব কম। নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে মজুরি বৈষম্য এখনও বর্তমান। রাজনীতি, সন্ত্রাস এবং যৌনতার প্রতি আমাদের আচরণ প্রতি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়, নারীর প্রতি কতটা অসম্মানজনক মনোভাব পোষণ করে এই সমাজ। এমনকি নানা সময়ে সংস্কৃতি চর্চার ভেতরেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কাঠামোগুলো বিশ্লেষণের পর আমরা আরো নিশ্চিত হই যে, একটি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনাপূর্ণ সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে নারী এখনো ঊনমানুষ, পুরুষের নিচে তার অবস্থান। নারীবাদ নারীর এই অবস্থানের অবসান চায়, পুরুষের পাশে সমমর্যাদা ও অধিকারসহ নারীকে পূর্ণ অধিষ্ঠান দিতে লড়াই জারি রাখে।

যদিও নারীবাদের লড়াই সংগ্রাম প্রায় দেড়শ বছর পার করেছে, তবু এখনও আমরা বাস করি একটা পুরুষের পৃথিবীতেই, পুরুষের তৈরি, পুরুষের জন্য গড়ে ওঠা এক সমতাহীন দুনিয়ায়। যে দুনিয়ায় পুঁজিবাদী অথনৈতিক ব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্র জন্ম নেয় নয়াপিতৃতন্ত্র (neopatriarchy) হয়ে, যেখানে বেড়ে ওঠা সামাজিক বৈষম্য আর পুরুষতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলে এবং অবশ্যই তা নারীর বিরুদ্ধে, নারীকে নানাভাবে বঞ্চিত, শোষন ও দমন করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা নিয়ে।

লেখক ও সাংবাদিক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *