জেলা প্রতিনিধি::
মাজেদার স্বামী যখন তাকে ছেড়ে চলে যান কোলে তখন তার ১ বছরের সন্তান হাসু। মাজেদার গরীব ও বৃদ্ধ বাবার সাধ্য ছিল না মেয়েকে সন্তানসহ সংসারে ফিরিয়ে নেওয়ার। বাবার নিজের পেটেই যে দাউদাউ ক্ষুধা। অনেক ধার দেনা করে এইতো মাজেদার বিয়ে দিয়েছেন। তখনও আছে দেনা পরিশোধের চাপ। তার মধ্যে মাজেদা বাবার বাড়িতে ফিরে এলে বাবা আশ্রয়টুকু দিলেন কিন্তু খাওয়াবেন কি?
মাজেদার বাবার বাড়ি কুড়িগ্রামের তিস্তার চর জোয়ান সাতরাতে । এই চরের অধিকাংশ মানুষ হতদরিদ্র। কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে। চরের ফসলি জমিতে কাজ চলে মাঝে মধ্যে। কোনরকম পেটে ভাতে কাজ । সেই কাজ পেতেও গৃহস্তের হাতে পায়ে ধরতে হতো। কি কাজ ছাড়া বাদবাকি দিনগুলো কি খাবেন? সন্তানকেই বা কিভাবে বাঁচাবেন?
তেমন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক এই চরের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ শুরু করে এমজেএসকেএস নামের একটি সংস্থা। সংস্থাটিকে অর্থায়ন করে সরকারের পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও সুইস কন্টাক্ট। সংস্থাটি মূলত বিভিন্ন সরকারী বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী সংস্থার সাথে সেবা পাওয়ার লিংকেজ করে থাকে।
মাজেদা এই সংস্থার মাধ্যমে অর্থ সহায়তা পেয়ে ৪ হাজার টাকায় কেনেন একটি ছাগল। মাত্র চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে মাজেদার ঘরে আছে ১২টি ছাগল। বিক্রি করে পেয়েছেন আরও প্রায় ৩০ হাজার টাকা। কোন কোন ছাগল বছরে তিনবারও বাচ্চা দিচ্ছে। প্রতিবার ২ থেকে ৪ টি করে বাচ বাচ্চা দেয়।
এভাবে কুড়িগ্রামের ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার বিস্তীর্ন চরাঞ্চলে ছাগল পালন দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিস্তীর্ণ চারণ ভূমি আর স্বল্প পুঁজিতেই অধিক লাভবান হওয়ায় অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন এই ছাগল পালনে। পরিবারের নারীরাই মূলত কাজটি করে সংসারে আয় বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখছেন।
মাজেদা বলেন, চরের ঘাস ছাড়া ছাগলের জন্য অন্য কোন খাবার দরকার পড়ে না। তাই বাড়তি খরচ নাই বললেই চলে। পুরোটাই লাভ হয়।
মাজেদার মত কুড়িগ্রামের চরের দরিদ্র পরিবারগুলোর নারীরা ছাগল পালন করে দারিদ্র্যতা ঘুচিয়েছেন। মাজেদার প্রতিবেশি জোসনা বেগমের ঘরেও এখন ১২ টি ছাগল। মরিয়ম বেগমের ৯ টি, রাবেয়ার ৯ টি, কাশেম আলির ৮ টি, মফিজলের ৮ টি, আবুল হোসেনের ৭ টি ছাগল।
জোসনা বেগম বলেন আমরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে উঁচু মাচায় ছাগল পালন করি। সময়মতো ছাগলের নানান রোগের চিকিৎসা নেই। উন্নতজাত হওয়ায় ছাগলগুলোর ৩/৪ টা করে বাচ্চা দেয়।
এই চরের শিরিনা বেগমের স্বামী আজাদুর বলেন, প্রতিবছর বন্যায় আমাদের বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়। আগে এমন সময় গবাদিপশুগুলো শুকনা জায়গা ও খাবার না পেয়ে নানা রোগে ভুগে মরে যেতো। এখন আমরা উঁচু মাচায় ছাগল পালন করি। আমার ঘরে এখন ৬ টা ছাগল, ৮ টা ভেড়া, ৬ টা গরু। জরুরি টাকার দরকার হলে এগুলো বেচতে পারি। আগের চেয়ে আমরা এখন অনেক ভালো আছি।
এলাকার পল্লী প্রাণী চিকিৎসক হারুন অর রশীদ জানান তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারি সহায়তা চরের গবাদিপশু চাষীদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা ও পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, উন্নত জাত নির্ধারন ও প্রজনন পরামর্শ কাজে লাগিয়ে চাষিরা অধিক লাভবান হচ্ছে।
এব্যাপারে সুইস কন্টাক্ট, জেলা সমন্বয়ক, ফরহাদ হোসেন জানান, চরগুলোতে আমরা কাজ শুরুর পর থেকে জনগণের জীবনমান অনেক বদলে গেছে। চরের কৃষি ও গবাদিপশু পালনে ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের উৎপাদিত ফসল ও গবাদিপশু যাতে ন্যায্য মূল্য পায় আমরা তাও নিশ্চিত করছি।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ মোঃ ইউনুছ আলী বলেন, নিঃসন্দেহে চরের গবাদিপশু জেলার মানুষের আমিষ ও দুধের চাহিদা মেটাতে বড় ভুমিকা পালন করছে। তাই সরকারের সকল সেবা যাতে প্রত্যন্ত চরগুলোতে পৌঁছে যায় সেজন্য আমরা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে কাজ করছি। চরাঞ্চলে উপযুক্ত পরিবেশে গবাদিপশু পালন, রোগ নির্নয় ও পরিচর্চার প্রশিক্ষন, পরামর্শ ও চিকিৎসা জনগণের দোড়গোড় পৌঁছে দিয়ে থাকি।