জলেশ্বরী রিপোর্ট :
কেউ গোলাপ আর কেউ রজনীগন্ধা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কেউ এসেছেন হাতে মেহেদি রাঙিয়ে। কারও মুখে হাসি। কারও চোখে আনন্দ-অশ্রু। সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা ২৩ নাবিককে বরণ করতেই এমন আয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই নাবিকরা ফিরে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত তর সই ছিল না স্বজনদের। ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে স্ত্রী, কারও ভাই, কারও মা-বাবা ছুটে এসেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ১ নম্বর জেটিতে। কারণ এখানেই নাবিকদের বরণের আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং।
মঙ্গলবার বিকাল পৌনে চারটার দিকে কুতুবদিয়ার বহির্নোঙর থেকে এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে নিয়ে এসআর শিপিংয়ের জাহাজ এমভি জাহানমণি জেটির কাছাকাছি আসে। তখন জাহাজের খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত নাবিকরা হাত নেড়ে অপেক্ষমাণ স্বজনদের সম্ভাষণ জানান। আর স্বজনরাও হাত নেড়ে সেই সম্ভাষণের উচ্ছ্বসিত জবাব দেন। জেটিতে ভেড়ার পর জাহাজ থেকে নেমে দেশের মাটিতে পা রাখতেই স্বজনরা ছুটে যান তাদের কাছে। একে অপরকে জড়িয়ে নেন বুকে। দীর্ঘ ৩৩ দিনের ভয়ংকর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া এবং এক মাসের ফেরার অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার সেই আনন্দের ঢেউ যেন আছড়ে পড়েছিল কর্ণফুলী নদীতে।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় এক মাসের দীর্ঘ যাত্রা শেষে এমভি আবদুল্লাহ কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। ওইদিনই এসআর শিপিংয়ের নাবিকদের নতুন একটি টিম চট্টগ্রাম থেকে রওয়ানা দিয়ে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে পৌঁছে। নতুন ক্যাপ্টেনের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন ক্যাপ্টেন। মঙ্গলবার বেলা পৌনে বারোটার দিকে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিয়ে কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা দেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা : বিকাল পৌনে চারটার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে এমভি আবদুল্লাহর মুক্ত ২৩ নাবিককে নিয়ে ভিড়ে লাইটার জাহাজ এমভি জাহানমণি-৩। তার আগেই এই জেটিতে বন্দরের উদ্যোগে প্যান্ডেল সাজিয়ে তৈরি করা হয় নাবিকদের বরণ করার মঞ্চ। দুপুর থেকেই নাবিক পরিবারের সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মীরা আসতে থাকেন অনুষ্ঠানস্থলে। একে একে আসেন চট্টগ্রাম বন্দর, জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং ও কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের (কেএসআরএম) কর্মকর্তারা।
জাহাজ জেটিতে ভেড়ার পরপরই একে একে নেমে আসতে থাকেন মৃত্যুঞ্জয়ী নাবিকরা। তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, কেএসআরএম-এর ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান ও সারোয়ার জাহান, এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করীম। ঢাকা থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও।
চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আজকে খুব আনন্দের দিন। আমাদের নাবিকরা বড় বিপদের মুখে ছিল। সরকার, জাহাজ মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় তারা মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন।
অনুষ্ঠানে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে শাহরিয়ার জাহান বলেন, মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আজকের এই দিনের জন্য আমরা অপেক্ষায় ছিলাম দুটি মাস। আমাদের নাবিক ভাইয়েরা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সার্বিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন। এজন্য সরকারকেও ধন্যবাদ। আমি প্রথমে ঘটনাটি অবহিত করেছিলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে। যেহেতু জাহাজটি বিদেশি জলসীমায় রয়েছে। এরপর নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদকে জানাই। পরে তাদের কাছ থেকে যত রকম সহযোগিতার দরকার ছিল তার সবই পেয়েছি। যখন এমভি আবদুল্লাহকে ফলো করা যুদ্ধ জাহাজগুলো দস্যুদের আত্মসমর্পণের হুমকি দিচ্ছিল এবং অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন আমি বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাই যে এতে আমাদের জাহাজ ও নাবিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। এর ২০ মিনিট পরই ওই যুদ্ধ জাহাজগুলো পিছিয়ে আসে। আমরা এভাবে সহযোগিতা পেয়েছি। এটা একটা উদাহরণ দিলাম। এ রকম আরও অনেক সহযোগিতা ছিল সরকারের তরফে। মাত্র দুই মাসে আমাদের নাবিকরা দেশে ফিরে এসেছেন। এটা আসলে বাংলাদেশের জয়। তারা সমুদ্র জয় করে ফিরে এসেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, জলদস্যুরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ হয়। তাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের একটি জাহাজ ও এর নাবিকরা ফিরে এসেছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং সম্মানের দিন। তাই আমরা বন্দরের পক্ষ থেকে ছোট একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। বিপদের মুখে আমাদের নাবিকরা অত্যন্ত সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে পররাষ্ট্র ও নৌ মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী সদর দপ্তর গোয়েন্দা সংস্থা, নৌমন্ত্রণালয় ও বন্দরসহ বিভিন্ন পক্ষ চমৎকার ভূমিকা পালন করেছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা টিমওয়ার্ক ছিল। যার কারণে সফলতা পাওয়া গেছে।
ফেরার অনুভূতি নাবিক ও স্বজনদের : চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের স্ত্রী দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন বন্দর জেটিতে। দুই কন্যা সন্তানের হাতে ছিল ফুলের তোড়া। জাহাজ থেকে নামার পরপরই তিনি ছুটে আসেন সন্তানদের কাছে। দুই কন্যা সন্তানকে দুই হাতে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খান। বাবাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা ছিল দুই কন্যা। জাহাজের নাবিক আইনুল হকের মাও ছেলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন জেটিতে। ছেলেকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘আজ যেন আমার জন্য ঈদের আনন্দ। ছেলে জিম্মি হওয়ার পর থেকেই অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন আমার ছেলে আমার কোলে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে বড় সুখের খবর আর কী হতে পারে।’ আইনুল হকও দেশবাসীর প্রতি, জাহাজ মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তাদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করায়। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমদের মা জোছনা বেগম জেটিতে বসে অপেক্ষা করছিলেন ছেলের জন্য। এক সময় ছেলেকে কাছে পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। জোছনা বলেন, খুব আনন্দ লাগছে। যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আজ ঈদের আনন্দ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। ছেলে যখন সোমালিয়ায় জলদস্যুর কবলে পড়েছিল তখন আতঙ্কে ছিলাম। কষ্টে ছিলাম। ছেলে সুস্থ দেহে ফিরতে পারবে কিনা, এই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। এখন ফিরেছে, ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ।
তিনি বলেন, আজ ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি। এর মধ্যে আছে গরুর মাংস, মুরগি, কই মাছ, শিমের বিচি। ছেলেকে আবার জাহাজে পাঠাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, এটা এমন পেশা জেনেশুনেই নিয়েছে নাবিকরা। বিপদ আছে, তাই বলে তো ঘরে বসে থাকা যাবে না। ছেলে আবার জাহাজে যেতে চাইলে যাবে। এতে পরিবার বাধা দেবে না।
হাতে মেহেদি পরে আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে নাবিক স্বামী নুর উদ্দিনকে বরণ করতে এসেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। স্বামী জাহাজ থেকে নামার পরপরই তিনি ছুটে যান। এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, খুব আনন্দ লাগছে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হলো। স্বামীকে কাছে পেয়েছি। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক ভালো লাগছে। তিনি হাতে মেহেদি রাঙিয়ে এসেছেন। ঈদের সময় স্বামী সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ছিলেন। তাই মেহেদি পরেননি। ঈদের আনন্দও ছিল না। স্বামীকে বরণ করার মধ্য দিয়েই তিনি ঈদ উদযাপন করছেন। স্বামীকে নিয়েই বাড়ি ফেরার উদ্দেশে কেএসআরএম-এর বাসে চড়ে বসেন তিনি।
ফ্লাশব্যাক : কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে। দুটি ছোট নৌযানে করে আসা দস্যুরা চলন্ত জাহাজটিতে উঠে সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে ভারী অস্ত্রের মুখে একটি কেবিনে আটকে রাখে। আটকের পর জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩৩ দিনের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল জাহাজ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্তি দেয় দস্যুরা। ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ২৩ নাবিককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। দস্যুদের ডেরা থেকে মুক্ত হয়ে ১৩ এপ্রিল রাতে সোমালিয়ার উপকূল থেকে আরব আমিরাতের পথে রওয়ানা দেয় এমভি আবদুল্লাহ। ২১ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছে। সেখানে কয়লা খালাস করে জাহাজটি একই দেশের মিনা সাকার বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে দেশের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে জাহাজটি সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কুতুবদিয়ায় বহির্নোঙরে নোঙর করে।
অনিশ্চিত জীবন থেকে ফিরে আসা ২৩ নাবিকের মধ্যে ১০ জনের বাড়ি চট্টগ্রামে। ১৩ জনের বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরে। চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের কেএসআরএম-এর নিজস্ব গাড়িতে করে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়া হয়।