:- লাইলী ইয়াসমীন
প্রায় ৩৩ বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন বড়বাড়ির ছোট বউটির উপর দায়িত্ব পড়লো বড় ভাইয়ের বখাটে ছেলেটিকে চোখে চোখে দেখে রাখার। তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। তিনবেলা তার খাবার ঘরে দিতে হবে। গোসলসহ জরুরি কারনে ঘরের বাইরে বের হলে তার পাশে পাশে থাকতে হবে।
বউটির নানা কাজ। তার নিজের কোলে ছোট বাচ্চা। সংসারে রান্নাসহ সকল কাজ সামলাতে হয়। কোনদিকে একটু অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ নেই। এক সন্ধ্যায় কোলের বাচ্চাকে রান্নাঘরের মেঝেতে মাদুরে বসিয়ে রান্না করছিলেন, হঠাৎ ওপারের গ্রামে ‘ধর’ ‘ধর’ চিৎকার! খড়ির চুলার আঁচ কমিয়ে ঘরের বাইরে আসতেই চিৎকার ও শোরগোল তীব্র হতে থাকে। ছোটবউ ঘরে থাকা ছেলেটিকে ডাকতে ডাকতে ঘরের দরজা অবধি যান। জবাব দেয় না কেউ। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা ঢুকাতেই দেখতে পান ছেলেটি ঘরে নেই। সাথে সাথে তার হিসেব মিলে যায়। এই শোরগোলের কারণ তাহলে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে!
ওপাড়ার মিষ্টি মেয়েটির বিয়ের ৪ বছর পর তার স্বামী গরু চুরির অপরাধে জেলে। মেয়েটির তখন একটি ২ বছরের মেয়ে ও সদ্যজাত এক ছেলেকে নিয়ে বাঁচা-মরার লড়াই। সেলাইয়ের কাজ করে তিনটা পেটের খাবার জোগায় মেয়েটি। এবাড়ির ছেলেটি প্রায়ই তার বাসায় যায়। তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। তাকে বিয়ের প্রলোভন দেয়। ঘরে ঢুকে বিছানায় যেতে জবরদস্তি করে। মেয়েটি বুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে চেষ্টা করে। পরে সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। যদিও মেয়েটি জানতোই বড়বাড়ির ছেলেদের নামে নালিশ করে লাভ নেই। সেবাড়ির অন্য পুরুষরাও একই রকম। বাবার বয়সী, দাদার বয়সীরাও গরীব ঘরের মেয়েদের দেখলে গায়ে পড়ার চেষ্টা করে, আঁচল ধরে টান দেয়, ঝুপঝাপ গায়ে হাত দেয়। কিন্তু কেউ রা টাও করে না। করলেই উল্টা বিচার হবে এমন ভয়ে।
সেদিন সন্ধ্যায় ছোটবউয়ের চোখ এড়িয়ে ছেলেটি সেই মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। মুখ চেপে ধরে জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে। একসময় মেয়েটির চিৎকারে আশপাশের অনেক লোক ছুটে এসে ছেলেটিকে ধরে আটকে ফেলেছে।
বড়বাড়ির ওপাড়ার প্রতিপক্ষ ঘটনাটি লুফে নেয়। আশেপাশের ৭ গ্রামের মোড়ল ও তিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন চলে যায় সাথে সাথে। সেরাতেই সবাই মহাসমারোহে একত্রিত হতে থাকে বাড়ির উঠানে। শত শত মানুষ। নারীরা দূরে অন্ধকারে, ঝোপেঝাড়ে দাঁড়িয়ে বিচার দেখছে। ঘটনার সাক্ষীদের বর্ণনা শুনে কয়েকজনকে দিয়ে জুরি করে সিদ্ধান্ত নিতে একটু অদূরে পাঠানো হয়। তখন রাত ৩ টা। জুরি ফিরে এসে সিদ্ধান্ত জানায় বড়বাড়ির ছেলেটিকে খুঁটিতে বেঁধে লোহার রোড দিয়ে ৫০ টি দোররা মারা হবে। তারপর তাকে সরিয়ে একই খুঁটিতে বেঁধে মেয়েটিকে ১০১ টি দোররা মারা হবে। কারণ মেয়েটি বিবাহিত ও সন্তানের মা। মেয়েটির ইশারা- ঈঙ্গিত না পেলে বড়বাড়ির সোনার ছেলে সেদিকে চোখ দিতো না।
ছোটবউ ঘর থেকে বিচারের রায় শুনতেছিলেন। তিনি এসে চিৎকার করে বললেন, ‘এটা কেমন বিচার? অপরাধীকে যদি শাস্তি দেন, ছেলেটিকে দেন, মেয়েটিকে কেন মারবেন? মেয়েটি তো ছেলেটিকে তার বাসায় ডাকেনি। বরং মেয়েটিই ছেলেটির প্রস্তাবে রাজি নয় বলে চিৎকার করে লোক জড়ো করেছিল। তাছাড়া তার ছোট ২ টা বাচ্চা আছে। তার সাথে এমন অন্যায় করবেন না।’ সমাজপতিরা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, ‘কে কথা কয়? ডেকে এনে অপমান! আমাদের বিচার যদি না হয় তো বাড়ির বউকে দিয়ে বিচার করাতেন।’ ছোটবউয়ের উপর এবার ভয়াবহ চাপ তৈরি হয়। পারলে তাকেও দোররার রায় দেয় এমন গর্জন উঠে চারদিকে।
সবাই খুশিতে ছোটাছুটি করছে। মাটিতে খুঁটির জন্য দুইটা বাঁশ পোতা হচ্ছে। যীশুর ক্রশের মতো করে আড়াআড়ি একটা বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। লোহার রডে গজ কাপড় পেঁচিয়ে রেডি করা হচ্ছে। যেন বিয়ে বাড়ির আয়োজন।
ছোটবউ মশারীর নীচ থেকে নিজের বাচ্চাটাকে টেনে তুলে বুকে চেপে ভীড় ঠেলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় উঠতে উঠতে একবার দোররার মঞ্চটাকে দেখে নেয়। পাশেই উঠানের ওকোণে মাটিতে লুটিয়ে বসে আছে মেয়েটি। হ্যাচাকের আলোয় তার বিবর্ণ মুখটি স্পষ্ট দেখে ফেলে ছোটবউ। তারপর তিনি হাঁটতে থাকেন রাস্তা ধরে। হাঁটতেই থাকেন, হাঁটতেই থাকেন। তিনি ততটা দূরে যেতে চান যেখানে এই নৃশংসতার আর্তনাদ পৌঁছাতে না পারে। এভাবে অন্ধকারে কতটা পথ তিনি হেঁটেছেন টের পাননি। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, তিনি এক বড় বটগাছের নীচে টংয়ের উপর বসে পড়েন বাচ্চাটাকে পাশে শুয়ে দিয়ে।
উল্লাস করতে করতে লোকজন ফিরে যাচ্ছে দলবেঁধে। ছোটবউ মুখ ঢেকে ফেলেন তাদের দেখে। সকালের সূর্য উঠতে শুরু করে। তার বাচ্চাটি জেগে উঠে কান্না জুড়ে দেয়। ছোটবউ বাচ্চা কোলে হাঁটতে হাঁটতে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন।
উঠানের খুঁটি দুটি উপরে পড়ে আছে। খুঁটির বাঁশে রক্তের দাগ! কিন্তু কোনো মানুষ নেই। কারো মুখে কোনো আওয়াজ নেই। ছোটবউয়ের চোখজোড়া বিবর্ণ মুখের মেয়েটিকে খুঁজে পায় না। ঘরে ফিরে দেখেন তার ঘরেই ছেলেটিকে শুয়ে রাখা হয়েছে। গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে তার সারা শরীর মুছিয়ে দেয়া হচ্ছে। গ্লাসে করে গরম দুধ খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তারপর….মেয়েটির সাথে গত ৩০ বছরে আর দেখা হয়নি ছোটবউয়ের। হঠাৎ সেদিন মেয়েটি ফোন দেয় ছোটবউকে। পরিচয় পেয়ে বিব্রত ছোটবউ নিজে থেকে কথা বাড়াতে সাহস পায় না। মেয়েটি বলে, আমি ভালো আছি। এখন আমার বাচ্চারা কাজ করে। আমি করিনা। শুধু মাঝে মাঝে রাতে যখন পাজরের ব্যথায় পাশ ফিরতে পারি না, ঘুম ভেঙে যায়, আপনাকে খুব মনে পড়ে। সেদিন আপনিই শুধু আমার হয়ে কথা বলেছেন। আর কেউ বলেনি। আমি হাসপাতাল থেকে সরাসরি ঢাকা চলে এসেছি, তাই আপনাকে বলে আসা হয়নি।
ছোটবউয়ের আর সেই বাড়ির বউ হয়ে থাকা হয়নি। এখনও তিনি অপরাধবোধে ভোগেন সবসময়। ছোট্ট করে জানতে চান মেয়েটির বাসার ঠিকানা। ভাবেন, একদিন গিয়ে মেয়েটির মাথায় হাত রেখে ক্ষমা চেয়ে আসবেন।
লেখক-শিক্ষক ও সাংবাদিক